এখনো সক্রিয় ভিওআইপি চোরাকারবারিরা

এখনো সক্রিয় ভিওআইপি চোরাকারবারিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল বা ভিওআইপির চোরাকারবার সরকারের রাজস্ব ফাঁকির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এখনো সচল। দায়িত্বশীলদের চোখে ধুলা দিয়ে এই ব্যবসায় ভর করে শত শত কোটি টাকা চলে যাচ্ছে একটি চক্রের কবজায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জালে মাঝেমধ্যে জড়িতদের কেউ কেউ ধরা পড়েন। তবে পুরো কারসাজির নেপথ্যের চক্রকে ধরা যায়নি একবারও। বর্তমানে কে এই চক্রের মূল হোতা? কার বা কাদের ইন্ধনে চলছে এই অবৈধ কারবার? এসব প্রশ্নের জবাবে শারুন-সাহাব সিন্ডিকেটের তথ্যই মিলছে।

সাহাব হচ্ছেন সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাহাব উদ্দিন। আর শারুন হচ্ছেন চট্টগ্রামের পটিয়া আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, তিনি রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে কার্যালয় খুলে নিয়ন্ত্রণ করছেন এই চোরাকারবার। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই অবৈধ কারবারে ব্যবহার করছেন টেলিটককে। টেলিটককে দীর্ঘদিন ধরে ভিওআইপির এই চোরাকারবারে ব্যবহার করার বিষয়টি নতুন এবং অপ্রকাশিত কিছু নয়।

বিটিআরসির তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৩১টি অপারেশনে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহার করা  ৫১ হাজার ৩৩১টি সিম উদ্ধার হয়। এসব সিমের মধ্যে টেলিটকেরই  ৩৯ হাজার ৮২৫টি। বাকি সিমের মধ্যে রবির ৯ হাজার ৩৭৯টি, এয়ারটেলের এক হাজার ২১৯টি, গ্রামীণফোনের ৬২৭টি এবং বাংলালিংকের ২৮১টি। দুটি কলসেন্টারে ও দুটি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিফোন সার্ভিস প্রভাইডারস বা আইপিটিএসপিতেও ভিওআইপি সরঞ্জাম মেলে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরদের জরিমানার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। অভিযোগ শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। মামলা চলছে ৯টি। তবে এসব মামলায় মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেপ্তার হওয়ারা দ্রুত জামিনে বের হয়ে আসছে। কর্তৃপক্ষের তদন্ত বেশি দূর এগোতে পারছে না।

এর আগে ২০১৮ সালে ৭৩টি অভিযানে পাওয়া যায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৩১০টি সিম। ওই বছরের ১৪ থেকে ১৮ অক্টোবর ঢাকা ও চট্টগ্রামে আইজিডাব্লিউ অপারেটরস ফোরামস (আইওএফ)-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বিটিআরসি ও র‌্যাব ভিওআইপির অবৈধ কারবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৪২ হাজার ১৫০টি সিম জব্দ করে। এসব সিমের মধ্যে রয়েছে রবির ১৬ হাজার ৮১২টি, টেলিটকের ১৫ হাজার ৯৩৯টি, বাংলালিংকের ছয় হাজার ১৭৬টি ও গ্রামীণফোনের তিন হাজার ২২৩টি।

চলতি বছরের সর্বশেষ গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি ও র‌্যাবের অভিযানে রাজধানী ঢাকার নিউ মার্কেট, তুরাগ ও শাহ আলী থানা এলাকায়  অভিযান পরিচালনা করে ভিওআইপির অবৈধ কারবারে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ১৯টি সিম বক্স ডিভাইস, ৪১৬টি জিএসএম অ্যান্টেনা, তিন হাজার ৪০০টি টেলিটক সিম ও সাত মিনি কম্পিউটারসহ অন্যান্য ভিওআইপি সামগ্রী। ওই সময় র‌্যাব বিটিআরসির কর্মকর্তাদের বরাতে জানায়, উদ্ধার হওয়া এসব টেলিকম সরঞ্জামের মাধ্যমে অবৈধ টেলিযোগাযোগ স্থাপনার মাধ্যমে প্রতিদিন আনুমানিক প্রায় ছয় লাখ মিনিট আন্তর্জাতিক কল অবৈধভাবে দেশে টার্মিনেট করা সম্ভব। এতে দৈনিক প্রায় তিন লাখ টাকা এবং বছরে প্রায় ১০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হতো।

সর্বশেষ ওই অভিযানের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফল হিসেবে বিশ্বজুড়ে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি ওভার দ্য টপ (ওটিটি)-এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলেও দেশে ভিওআইপির মাধ্যমে সাধারণ ফোনে কল আদান-প্রদান তেমনটা কমেনি।

এ বিষয়ে বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদির মাধ্যমে কথা বলতে হলে উভয় প্রান্তেই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় গতির ইন্টারনেট সংযোগও থাকতে হবে। কিন্তু দেশে স্মার্ট ফোনের ব্যবহার এখনো অনেক কম। ইন্টারনেট সব এলাকায় সহজলভ্য নয়। এ কারণে প্রচলিত ভিওআইপি কলের চাহিদা এখনো ব্যাপক। কিন্তু এই চাহিদার পরও লাইসেন্সধারী ভিএসপি (ভিওআইপি সার্ভিস প্রভাইডার) ও আইজিডাব্লিউ অপারেটররা বিপাকে। বিদেশ থেকে আসা ৬০ শতাংশ কলই চোরাকারবারিদের পথে চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ভিএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবিউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চরম হতাশার মধ্যে আছি।’ আইওএফ-এর সঙ্গে যুক্ত একটি আইজিডাব্লিউ অপারেটরের কর্তকর্তা বলেন, বিটিইআরসি মাঝেমধ্যে যে অভিযান চালাচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। গত ফেব্রুয়ারির পর আর কোনো অভিযান নেই। চক্রের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিটিআরসির পরিদর্শকদলের প্রতিবেদন : ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের বিরুদ্ধে গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারির সর্বশেষ ওই অভিযানের পর গত ২৩ ও ২৪ মার্চ টেলিটকের নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার (এনওসি) এবং রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের প্রধান কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে বিটিআরসির পরিদর্শকদল। পরির্দশনে যেসব তথ্য মেলে তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভিওআইপির অবৈধ কারবারের সঙ্গে টেলিটকের কর্মকর্তরা জড়িত।

পরিদর্শকদলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাঁরা তাঁদের অনুসন্ধানে জানতে পারেন জব্দ করা সিমের কিছু অংশ রাত  ৩টার সময়ও অ্যাক্টিভেট করে দেওয়া হয়েছে। একটি সিম বা নম্বর টেলিটক নেটওয়ার্কে ৮০টিরও বেশি আইএমইআই-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে,  যা ব্যক্তি আচরণবহির্ভূত। শুধু মেশিনের মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব। জব্দ করা অন্যান্য সিমের ব্যবহারও করা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। জনৈক কলি বেগমের ব্যবহার করা সিম হয়েছে ৬১টি পৃথক আইএমইআই নম্বরে। এ ছাড়া ৬১টি আইএমইআই-তে এর আগে ২৬১টি (ইউনিক ১৫২) এমএসআইএসডিএন ব্যবহৃত হয়েছে। স্মার্ট সিম সার্ভারের মাধ্যমে অটোমেটিক আইএমইআই জেনারেট বা পরিবর্তন করে এসব সিম ব্যবহৃত হয়েছে।

বিটিআরসির পরিদর্শকদলের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, টেলিটকের সেলস ও ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিআরএম ডিভিশন এবং সিস্টেম অপারেশন ডিভিশনের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া শুধু ডিস্ট্রিবিউটর বা রিটেইলারদের একই আইএমইআই ও এনআইডির অনুকূলে একাধিক সিরিজ সিম বিক্রির সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।

বিটিআরসির পরিদর্শকদলের আরো পর্যবেক্ষণ, টেলিটকের সিআরএম থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ১৫৭৫৪১৭৪১৭ নামের এমএসআইএসডিএন-টি নেটওয়ার্কে ২০২০  সালের ২ মে চালু হয় এবং ২০২১ সালের চার ফেব্রুয়ারি সাসপেন্ড করা হয়।  অর্থাৎ গত ৩ ফেব্রুয়ারি  ভিওআইপির  অবৈধ স্থাপনা শনাক্তের পরের দিন এটা সাসপেন্ড করা হয়;  যদিও তখন পর্যন্ত ওই  সিম বন্ধের কোনো নির্দেশনা বিটিআরসি দেয়নি।  এতেও ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের সঙ্গে টেলিটকের কর্মকর্তাদের  জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া অবৈধ কল টার্মিনেশন রোধের জন্য বিটিআরসি নির্ধারিত সেলফ রেগুলেশন প্রসেস (এসআরপি) ও সংশ্লিষ্ট অপারেটর পরিচালিত সেলফ রেগুলেশন (এসআর) লজিকগুলো টেলিটকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যথাযথভাবে প্রতিপালন করছেন না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বর্তমানে বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল আসছে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি মিনিট। এর মধ্যে ৭০ লাখ থেকে ৮০ লাখ মিনিট কল আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম প্রতিষ্ঠান বিটিসিএলের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডাব্লিউ) দিয়ে, আর বাকিটা আসছে বেসরকারি আইজিডাব্লিউ অপারেটর ফোরাম (আইওএফ)-এর মাধ্যমে। অন্যদিকে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি মিনিট কল এখনো ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের মাধ্যমেই আসছে।

এদিকে কালের কণ্ঠ’র তথ্য অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে একটি চিঠি। গত ১৪ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে উদ্দেশ্য করে তাঁর দপ্তরে চিঠি দেন জনৈক নুরুল জিহাদ। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা চিঠিটি গ্রহণ করেন। চিঠির সূত্র ধরে জানা যায়, শারুন চৌধুরীর সঙ্গে শুধু টেলিটকের এমডি সাহাব উদ্দিন নন, আছে চেনা-অচেনা আরো অনেক মুখ। আছে বিভিন্ন সময়ের বিতর্কিত ব্যক্তিরাও। শারুনের অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বলয়টা গড়ে উঠেছে একসময় হাওয়া ভবনের সঙ্গে যুক্ত একটি সিন্ডিকেট ঘিরে।

ভিওআইপির অবৈধ কারবারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ র‌্যাবের সেই অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটা এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের মালিকই আমাদের ছাড়িয়ে এনেছেন।’ কিন্তু তিনি তো বিদেশে থাকেন—এ প্রশ্নে যুবকটি বলেন, ‘শুনেছি এক সংসদ সদস্যের ছেলে আমাদের জামিনের জন্য তদবির করেছিলেন। তাঁর কারণেই আমাদের ভিওআইপি ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।’ কী নাম সেই সংসদ সদস্যের ছেলের—এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আর কল করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু টেলিটক নয়, অন্যদের সিমও কমবেশি ভিওআইপির চোরাকারবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মিলে একটি অপরাধচক্র এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। আর বিটিআরসির কাছেও এখনো ভিওআইপি পুরোপুরিভাবে মনিটরিং করার টেকনোলজি নেই। তাদের অভিযানে পাওয়া তথ্যে এ অপরাধের সার্বিক চিত্র উঠে আসছে না।

ভিওআইপির অবৈধ কারবারে টেলিটকের এত বেশি সিম ব্যবহার হচ্ছে কিভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে টেলিটকের এমডি সাহাব উদ্দিন সরাসরি জবাব দেননি। অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘র‌্যাবের অভিযানে পাওয়া তিন হাজার ৪০০ সিমের জন্য প্রায় এক হাজার ৪১৩টি এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল। আমরা তাঁদের সবার নামের তালিকা ও এনআইডি নম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং র‌্যাবকে দিয়েছি। আমরা এসব সিম বিক্রির দায়ে তিন রিটেইলারের লাইসেন্সও বাতিল করেছি। তদন্তে যদি ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো কর্মকর্তার নাম উঠে আসে তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তথ্য প্রুযুক্তি