সাহাদাত হোসে পরশ |
ধনকুবের হিসেবে বহুল পরিচিত মুসা বিন শমসের ওরফে প্রিন্স মুসা। জনশ্রুতি রয়েছে সুইচ ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও ব্যাংকে তার কোটি কোটি টাকা রয়েছে। তবে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে (ডিবি) মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘তার সম্পদের সবই মিছে। সুইস ব্যাংকে তার এক টাকাও নেই। মুসার বিপুল অর্থ-বিত্ত নিয়ে যেসব জনশ্রুতি আছে তা মিথ্যা। সম্পদ নিয়ে তিনি মুখরোচক কথা বলেন।’
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের অর্থ অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আলোচনার জন্ম দেন মুসা। যুক্তরাজ্যে নির্বাচনের আগে তিনি অনুদানের ঘোষণা দেন। পদ্মা সেতু নিয়ে যখন বিশ্বব্যাংকের টানাপোড়েন চলছিল তখনও সুইস ব্যাংকে টাকা আছে দাবি করে মুসা বলেন- উদ্ধার করতে পারলে ওই অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু করে দেবেন। মঙ্গলবারও ফের মুসা বলেছেন- সেই সুইচ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধার করতে পারলে পুলিশকে ৫০০ কোটি টাকা দেবেন। দুদককে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ভবন করে দেবেন এবং দ্বিতীয় পদ্মা সেতু তৈরি করে দেবেন।
তবে মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, ‘মুসা নিজের অর্থ সম্পদ নিয়ে যা দাবি করছেন তা আসলে ফাঁকা বুলি। মুখরোচক গল্প বলতে পছন্দ তার। সুইস ব্যাংকে তার কোনো অর্থই নেই। প্রতারক কাদেরের সঙ্গে উল্টো বাটপারি করতে চেয়েছিলেন মুসা।’
এর আগে প্রতারণা করে অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আবদুল কাদের চৌধুরী ওরফে কাদের মাঝির সঙ্গে সংশ্নিষ্টতায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যান। বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে মেরুন রঙের এফ প্রিমিও গাড়িতে করে তারা ডিবি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। সাড়ে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটের দিকে তিনি ডিবি কার্যালয় থেকে বের হন। পরে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রী এবং ছেলেকে প্রতারক কাদেরের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে মুসা দাবি করেছেন- তিনি কাদেরের প্রতারণার বিষয়ে কিছু জানেন না। আমরা তাকে বলেছি, একজন নাইন পাস লোককে আপনি না বুঝে কীভাবে নিয়োগ দিলেন, তার থেকে ১০ কোটি টাকা নিয়ে কীভাবে লাভসহ ২০ কোটি টাকার চেক দিলেন? কাদেরের সঙ্গে মুসার অনেক কথোপথনের তথ্য পাওয়া গেছে। কাদেরকে ‘বাবা’, ‘সোনা’ বলেও সম্বোধন করতেন মুসা।’
হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মুসার কাছে বার বার জানতে চাওয়া হয়- কীভাবে দশম শ্রেণি পাস একজনকে তার আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। প্রয়োজনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও ডাকা হতে পারে।’
এদিকে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে একজন ব্যক্তি আমার অফিসে যান। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছিলেন। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বসে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন লোকদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাদের মধ্যে প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে গল্প করতেন। তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। পরে নিশ্চিত হই- সে অতিরিক্ত সচিব নয়। ভুয়া অতিরিক্ত সচিব। এরপর তাকে অফিস থেকে বের করে দেই। আমিও তার প্রতারণার শিকার। তার ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে আমার আর বলার কিছু নেই। আমার শরীর-স্বাস্থ্য এখন ভালো না।’
মুসা আরও বলেন, ‘ডিবি আমাকে কাদেরের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি যা যা জানি সবকিছু স্পষ্টভাবে বলেছি। আমার বক্ত্যব্যে পুলিশ সন্তুষ্ট। কাদের মিথ্যা কথা বলেছে। তিনি আমার আইন উপদেষ্টা ছিলেন না।’
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসা থেকে কাদের নামে এক ভুয়া অতিরিক্ত সচিবকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ সময় আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় কাদেরের প্রাডো গাড়ি। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী ও সততা প্রোপার্টিজের চেয়ারম্যান শারমিন চৌধুরী ছোয়া, অফিস ম্যানেজার শহিদুল আলম ও অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।
জানা যায়, প্রতারণা করেই অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন আবদুল কাদের। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে। ঢাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। নয়তলা বাড়ি কিনেছেন গাজীপুরে। যদিও এক সময় মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন কাদের। এরপর চাকরিপ্রার্থী, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের প্রতারিত করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। কাদের নিজেকে মুসার আইন উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার বেশ কিছু ভুঁইফোড় কোম্পানিও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে হলো- ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মোটরস।