দেশের বিভিন্নস্থানে হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার রেশ কাটিয়ে না উঠতেই ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের হিন্দু পরিবারের ২৫টি বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রোববার (১৭ অক্টোবর) রাতে রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। এ সময় নগদ অর্থ, মালামাল, গরু-ছাগলসহ সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সে ঘটনায় জড়িতদের ‘তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত’ করা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জড়িত সন্দেহে ৪৫ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানা গেছে, হামলার আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোটরসাইকেল দিয়ে ১৫ জন যুবক এলাকায় মহড়া দেয়। কারা এই মহড়া দেয় প্রশ্ন এলাকাবাসীর, তাদের কেউ চেনেন না। হামলার আগে স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকে কেউ উসকানিমূলক ঘোষণা দেয়। এর পরই হামলা, লুটপাট শুরু হয়।
রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার জানান, ফেইসবুকে এক হিন্দু কিশোরের অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্ম অবমাননা হয়েছে এরকম খবর ছড়িয়ে পড়ে। এনিয়ে রোববার বিকেল থেকে উত্তেজনা চলছিল ওই এলাকায়। থানা পুলিশ সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পৌরমেয়রসহ ওই কিশোরের বাড়িতে অবস্থান নেয় বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে বেশ কিছু উত্তেজিত মানুষ ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত ৯টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত ওই বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে করিমপুর-কসবা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালায়। উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের উত্তর করিমপুরের ওই গ্রামের ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নারকীয় তান্ডব চালায়। তারা দুটি মন্দিরসহ আশপাশের দোকানপাটেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে সবগুলো বাড়িঘর, দোকানপাট আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়। আতঙ্কে নারী-পুরুষ অনেকেই আশ্রয় নেন পাশের ধানক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গায়।
পুলিশ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেখানে ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। রাত আড়াইটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাতভর সেখানে ছিলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে রংপুরের পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার রায় জানান, এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পীরগঞ্জ থানার ওসি সুরেশ চন্দ্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে ওই কিশোরকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটনাস্থল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে হিন্দুগ্রামে এক দল দুর্বৃত্ত পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ও মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মালামাল লুট করেছে।
‘ওই গ্রামের মানুষের এ ঘটনার সঙ্গে কোন সম্পৃক্তি ছিল না। আসলে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা ২০ জনকে আটক করেছি। অভিযান অব্যাহত আছে,’ বলেন পুলিশ সুপার।
রংপুরের ডিসি আসিব আহসান বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত ঘটনা। দায়ীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল জানান, তিনি সারারাত ঘটনাস্থলে ছিলেন। তার অভিযোগ এলাকার ‘জামায়াত-শিবির এবং পাশের গাইবান্ধার পলাশবাড়ি, সাদুল্লাপুরের জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে’ এ তান্ডব চালিয়েছে। এখানে ‘বিএনপিরও ইন্ধন আছে’ বলে মনে অভিযোগ তার। স্থানীয় মুসলমানরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।
পীরগঞ্জের ঘটনা সম্পর্কে সোমবার (১৮ অক্টোবর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পীরগঞ্জে যা ঘটেছে তাকে ‘আরেকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ঘটনার সূত্রপাত এক কিশোরের ফেইসবুকে একটা পোস্ট নিয়ে। ইচ্ছায় দিক, অনিচ্ছায় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক, স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন এ ঘটনা আঁচ করে ছেলেটি যেখানে থাকত, সেখানে অভিযান চালায়। তবে ছেলেটিকে পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রী বলেন, ওই গ্রামের নিরাপত্তা দিতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন ছিল, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, তারা দুষ্কৃতকারী। এই দুষ্কৃতকারীরা তখন এই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে পীরগঞ্জ থানার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের কয়েকটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, সেখানে ২৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। দুষ্কৃতকারীরা বাড়িঘর লুট করেছে। ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর লুটপাট এবং ভাঙচুর করেছে।
পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সেখানে ‘ঘটনা ঘটানো হয়েছে’ মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাতেই অতিরিক্ত পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব আর বিজিবি সেখানে গেছে। আমাদের নিরাপত্তার যত ধরনের ব্যবস্থা সেটি আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ ঘটনাটা আকস্মিকভাবেই দুষ্কৃতকারীরা ঘটিয়ে ফেলেছে।
তিনি জানান, জেলা প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ অর্থ ও কাপড় বিতরণ করেছে। স্থানীয় এমপি জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও উদ্যোগ নিয়েছেন। বাড়ি নির্মাণের জন্যও প্রধানমন্ত্রী নিদর্শনা দিয়েছেন, যার যা প্রয়োজন হয় দেয়া হবে। খুব শীঘ্রই তাদের বাড়িঘর তৈরি করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত এ পর্যন্ত ৪২ জনকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি আসামির ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে আমরা হিসাব নেব। তাদের জবাবদিহি করতে হবে। ভবিষতে যেন কোন দিন এসব ঘটনা ঘটাতে না পারে।
ডিআইজি বলেন, কিছু কুলাঙ্গার এদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবে, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করবে, আমরা তা হতে দেব না। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
পরে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওহাব ভুইয়া ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ঘোষণা দেন প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে সব প্রকার সহায়তা দেয়া হবে।
এদিকে রাত থেকে বিজিবি পুলিশ র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশাল বহর এলাকায় অবস্থান নিলেও অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ও শিশুদের মাঝে। এছাড়া হামলা চালানোর আগে পাঁচটি পালচার মোটরসাইকেল নিয়ে বটেরহাট এলাকায় মহড়া দিয়েছে কারা- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এলাকাবাসীর মাঝে।
সরজমিন রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর ও কসবা মাঝিপাড়া গ্রামে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানা গেছে
কসবা গ্রামের প্রশান্ত রায়ের ছেলে পরিতোষ রায়ের নামে ফেইসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর একটি পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠলে মুহূর্তের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে যায়। এ সময় এলাকার কিছু লোক বিষয়টি নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করে। পার্শ্ববর্তী বটেরহাট মসজিদ থেকে মাইকযোগে প্রচার চালানো হয়-পবিত্র কোরআন শরীফের অবমাননা করা হয়েছে, মুসলমান ভাইয়েরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসুন।
এদিকে আশপাশের গ্রাম থেকে ও পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধার পলাশবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক হাজার সন্ত্রাসী পেছন থেকে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্ন অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পরেশের বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটারেরও বেশি পাশের গ্রাম কসবা মাঝিপাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
হামলার আগে পাঁচটি পালসার মোটরসাইকেলের রহস্য রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাঁচটি পালচার মোটরসাইকেলযোগে ১৫ জন যুবক বটেরহাট এলাকায় আসে। তারা বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে কয়েকজনের সঙ্গে একান্তে কথা বলে। এরপর তারা আবারও মোটরসাইকেলে ব্রিজ পার হয়ে মাঝিপাড়ার দিকে চলে যাওয়ার পর পরই হামলার ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীরা জানিয়েছে। এই মোটরসাইকেলে কারা এসেছিল- বিষয়টি উদঘাটন করতে পারলে অনেক রহস্য উদঘাটিত হবে বলে এলাকাবাসী মনে করেন।
বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার আগে মালামাল লুট করার নেপথ্যে
৭০টি বাড়ির সব বাড়িতে প্রবেশ করে নগদ অর্থসহ মালামাল বিশেষ করে অটোরিকশা, গরু-ছাগল লুট করেছে। এরপর ২০টি বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং ৫০টি বাড়ি ভাঙচুর করেছে।
সরজমিন ঘটনাস্থল ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তারা অভিযোগ করে হামলাকারীরা উগ্র ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে প্রথমে মালামাল লুটপাট করে। এরপর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের হামলায় নারী-পুরুষসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ধানক্ষেতে আশ্রয় নেয়। রোববার গভীর রাত পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা তান্ডব চালায়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন মাইকযোগে পালিয়ে যাওয়া লোকজনদের বাড়িঘরে ফিরে আসার আহ্বান জানালে তারা বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু সবগুলো বাড়িঘর ভস্মীভূত হওয়ায় তাদের পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সব লুট করে নিয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেন, পরেশের বাড়ি রক্ষার চেষ্টা করল পুলিশ, কিন্তু সন্ত্রাসীরা যে হিন্দুগ্রামে হামলার পরিকল্পনা করছে, তা তাদের বলার পরেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পুলিশ আগে থেকে অবস্থান নিলে এমন ম্যাচাকার হতো না। এখন পুলিশ, বিজিবি দিয়ে আমাদের পাহারা দিয়ে লাভ কী? সবই তো শেষ হয়ে গেছে।