মিজান চৌধুরী
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরগতি ও বিনিয়োগ মন্দার কারণে দেশি-বিদেশি খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার হার কমেছে।
প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ কম নেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের ৪ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণ সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করেছে ‘ক্যাশ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি (সিডিএমসি)’। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সরকারের ঋণ ও নগদ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিডিএমসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সিনিয়র অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ট্রেজারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয়। পাশাপাশি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস এবং দ্বিতীয় ছয় মাসের ট্রেজারি বন্ড ও বিলের অকশন ক্যালেন্ডার অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সরকারি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা হার কমে যাওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মূলত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কম হওয়ায় ঋণের প্রবাহ কমেছে। তিনি বলেন, সাধারণত আমাদের দেশে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় না। এটা বছর শেষে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। ফলে ওই সময় সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বাড়বে।
সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সুদ হার কমানোর পরও বর্তমান ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি রেট অব ইন্টারেস্ট (সুদহার) সঞ্চয়পত্রে। পাশাপাশি আমানতকারীদের আস্থার জায়গা বেশি সেখানে। এ দুই কারণেই সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করছে। এখান থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কম। হয়তো প্রয়োজন হচ্ছে না বিধায় সরকার ব্যাংক ঋণ কম নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে বৈদেশিক খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি সফট ঋণ নিতে হবে। বিশেষ করে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারলে ভালো। দীর্ঘমেয়াদি এই সফট ঋণের দিকে নজর দিতে হবে। তবে সরকারের সার্বিক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কম হচ্ছে এমন ইঙ্গিতই বহন করে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই তিন মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়নের হার ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ১৯ হাজার ৫৫৯ কোটি। এ সময় ৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের ১ শতাংশও খরচ করতে পারেনি। এগুলো হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্ম কমিশন এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
চলতি অর্থবছরে সরকার ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে ‘ক্যাশ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি (সিডিএমসি)’ বৈঠকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ করতে ট্রেজারি বন্ড থেকে ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং ট্রেজারি বিল থেকে ২৪ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিডিএমসি বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের জন্য মাসভিত্তিক প্রকৃত ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অকশন ক্যালেন্ডার পর্যালোচনা করে অর্থসচিবের কাছে পাঠানোর কথা বলা হয়।
সূত্র মতে, লক্ষ্যমাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা থাকলে মূলত নেওয়া হয় ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কম নিয়েছে ৪ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ট্রেজারি বন্ড থেকে ৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা এবং ট্রেজারি বিল থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
একইভাবে দেখা গেছে, বিদেশি ঋণ প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ হয়নি। প্রথম প্রান্তিকে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দাতা সংস্থাগুলো ঋণ ছাড় করেছে ১৬ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। যদিও এ সময় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাওয়ার কথা ২৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী এ খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে ৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
তবে ঋণ নেওয়া বেড়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। এ বছর ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এ খাত থেকে। প্রথম প্রান্তিকে নিট ঋণ নেওয়া হয় ১১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এটি প্রথম প্রান্তিকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেশি। মূলত ব্যাংক থেকে সুদহার বেশি থাকায় আমানতকারীরা এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। যে কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও বেড়েছে।