রহমত রহমান: আধুনিক, দক্ষ ও টেকসই কর প্রশাসন গড়ে তোলার জন্যই গঠিত হয় বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), আয়কর। উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিকে এলটিইউতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ করসেবা প্রদান এবং কর ফাঁকি রোধ করা। কিন্তু গত আট বছরেও সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট। দেশের অনেক বড় বড় কোম্পানিকে এখনও এলটিইউতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি এনবিআর আদেশ জারি করার পরও এলটিইউ’র অধিক্ষেত্রাধীন কিছু কোম্পানি ও বেশিরভাগ কোম্পানির পরিচালককে এলটিইউতে আনতে পারেনি।
তবে বর্তমানে এলটিইউতে থাকা কোম্পানিগুলোর ৫১৭ জন পরিচালক ও ১৬টি কোম্পানির কর ফাইল এলটিইউ’র কাছে হস্তান্তর করতে ২৭টি কর অঞ্চলকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এলটিইউ’র কমিশনার এই চিঠি দেন। ইতোমধ্যে চারটি কোম্পানি ও ৩৬ জন পরিচালকের ফাইল এলটিইউতে এসেছে। সবগুলো কর ফাইল এলটিইউতে হস্তান্তর হলে কর আহরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন এলটিইউ’র কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বাজার, ইউনিলিভারসহ দেশীয় ও বহুজাতিক বড় কোম্পানিগুলোকে এলটিইউতে স্থানান্তর করতে এনবিআরকে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে এলটিইউ।
এনবিআর সূত্রমতে, এনবিআর ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর অধিক্ষেত্র-সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে। যাতে বলা হয়, ‘সকল বিদ্যমান ও ভবিষ্যতে গঠিতব্য ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তাদের সকল পরিচালকের আয়কর মামলার অধিক্ষেত্র এলটিইউ, ঢাকা এর নিকট ন্যস্ত থাকবে।’ অর্থাৎ এই আদেশ অনুযায়ী দেশের সব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়কর ফাইল এলটিইউতে থাকবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ফাইলও এলটিইউতে থাকবে। এই আদেশের পরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ফাইল বিভিন্ন কর অঞ্চলে রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় চেষ্টার পরও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এসব ফাইল এলটিইউতে আনা সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী এলটিইউ’র অধিক্ষেত্রাধীন ৫১৭ জন ব্যক্তি করদাতা (বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক) ও ১৬টি কোম্পানি করদাতার আয়কর ফাইল চেয়ে সম্প্রতি এলটিইউ কমিশনার বিভিন্ন কর কমিশনারদের চিঠি দেয়। ব্যক্তি করদাতার মধ্যে কেন্দ্রীয় কর অঞ্চলে ছয়টি, কর অঞ্চল-১, ঢাকায় ৩৫টি, কর অঞ্চল-২, ঢাকায় ২৪টি, কর অঞ্চল-৩, ঢাকায় ৩২টি, কর অঞ্চল-৪, ঢাকায় ৩৮টি, কর অঞ্চল-৫, ঢাকায় ৩৬টি, কর অঞ্চল-৬, ঢাকায় ৪১টি, কর অঞ্চল-৭, ঢাকায় ১৩টি, কর অঞ্চল-৮, ঢাকায় ৫৩টি, কর অঞ্চল-৯, ঢাকায় ১৬টি, কর অঞ্চল-১০, ঢাকায় ১৮টি, কর অঞ্চল-১১, ঢাকায় ১৮টি, কর অঞ্চল-১২, ঢাকায় ৩৯টি, কর অঞ্চল-১৩, ঢাকায় সাতটি, কর অঞ্চল-১৪, ঢাকায় ১৪টি, কর অঞ্চল-১৫, ঢাকায় ২৫টি, কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামে ১৮টি, কর অঞ্চল-২, চট্টগ্রামে ২৮টি, কর অঞ্চল-৪, চট্টগ্রামে ১৭টি ও কর অঞ্চল-৪, চট্টগ্রাম ৯টি, কর অঞ্চল খুলনায় ১৩টি, কর অঞ্চল রাজশাহীতে ছয়টি, কর অঞ্চল সিলেটে চারটি, কর অঞ্চল নারায়ণগঞ্জে তিনটি, কর অঞ্চল বগুড়ায় দুটি, কর অঞ্চল বরিশালে একটি ও কর অঞ্চল কুমিল্লায় একটি ফাইল চাওয়া হয়েছে।
১৬টি কোম্পানি করদাতার মধ্যে রয়েছে কর অঞ্চল-৮, ঢাকার আওতাধীন বিকাশ লিমিটেড, বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেড, আবাসি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। কর অঞ্চল-৭, ঢাকার আওতাধীন ইম্পেরিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, কর অঞ্চল-৬, ঢাকার আওতাধীন রিভারস্টোন ক্যাপিটাল লিমিটেড, কর অঞ্চল-৫, ঢাকার আওতাধীন প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, কর অঞ্চল-৪-এর আওতাধীন সিভিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড, সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড ও কসমোপলিটন ফাইন্যান্স লিমিটেড। কর অঞ্চল-৩-এর আওতাধীন মাইডাস ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, কর অঞ্চল-১-এর আওতাধীন অ্যালায়েন্স ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড, আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ও এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স।
এলটিইউ সূত্রমতে, চিঠি দেয়ার পর বিভিন্ন কর অঞ্চল থেকে চারটি কোম্পানি ও ৩৬ জন ব্যক্তি করদাতাসহ মোট ৪০টি করফাইল এলটিইউতে এসেছে। কোম্পানি চারটি হলো বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, আবাসি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ইস্টার্ন ক্যাপিটাল লিমিটেড। আবার এসব ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার ই-টিআইএন নিবন্ধন যেসব কর অঞ্চল থেকে পাঠানো হয়েছে, সেসব কর অঞ্চলের নামে রয়েছে। ফলে আরেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। এসব ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার নিবন্ধন এলটিইউ’র নামে স্থানান্তর করতে এলটিইউ থেকে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এলটিইউ’র কমিশনার মো. ইকবাল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী এলটিইউতে থাকা কোম্পানির পরিচালকদের এলটিইউতে আসা উচিত। এসব পরিচালক উল্লেখযোগ্য হারে কর দিয়ে থাকেন। এলটিইউতে এসব পরিচালকদের ফাইল আসলে এলটিইউ’র রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘দেশীয় ও বহুজাতিক অনেক কোম্পানি এলটিইউতে আসা উচিত। এসব কোম্পানিকে এলটিইউতে আনার ক্ষেত্রে অধিক্ষেত্র সংশোধনের জন্য আমরা এনবিআরকে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।’
এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশীয় ও বহুজাতিক বড় কোম্পানিগুলোকে করসেবা দেয়া ও করফাঁকি রোধে এলটিইউ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষায়িত এলটিইউকে আমরা সেভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। এমনকি আদেশ জারির পরও অনেক কোম্পানি ও কোম্পানি পরিচালককে এলটিইউতে আনা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘যেসব কোম্পানি ও কোম্পানির পরিচালকদের ফাইলের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে, তা এলটিইউতে এলে ভালো হবে। বার্জার, ইউনিলিভারের মতো বড় বড় কোম্পানিগুলোকে এলটিইউতে আনা উচিত। এসব কোম্পানি এলটিইউতে এলে কর আদায়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’
এনবিআর সূত্রমতে, এনবিআরের আয়কর লক্ষ্যমাত্রার সিংহভাগই জোগান দেয় এলটিইউ। উৎসে আয়করের বেশিরভাগ জোগান দেয় এলটিইউ। বিদায়ী অর্থবছরে এলটিইউ ২৪ হাজার ১১ কোটি টাকার বেশি কর আহরণ করেছে। বিদায়ী অর্থবছর এলটিইউর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১১ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে। ৫ বছর পর আবারও লক্ষ্য অর্জন করল এলটিইউ। ৬ বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করেছে এলটিইউ। এলটিইউতে মোট করদাতার সংখ্যা এক হাজার ১৫৯। এর মধ্যে কোম্পানি করদাতা ৪৩৯। কোম্পানি করদাতার মধ্যে ৬২টি ব্যাংক, পাঁচটি মোবাইল কোম্পানি, ৩৯টি লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, ৪৭টি মার্চেন্ট ব্যাংক, ৪৮টি সাধারণ বিমা, ৩২টি জীবন বিমা, ১২টি ফার্মাসিউটিক্যালস, পাঁচটি টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং, ২৭টি টেক্সটাইলস, ১৪টি গার্মেন্ট, ৯টি মাল্টিপল প্রডাক্টস, ৭৪টি ম্যানুফ্যাকচারিং, ৬৫টি অন্যান্য কোম্পানি। আর ব্যক্তি করদাতা ৭২০। যার মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানির পরিচালক।