সম্প্রতি শেষ হয়েছে দুই সপ্তাহব্যাপী জাতিংঘের শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’। এ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে ৯৯টি দেশের সঙ্গে এক চুক্তিতে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ।
এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৯০ মিলিয়ন টন বা মোট নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ২২ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সত্যের বিপরীতে। চুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছানোর সেই একই সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ তার বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বর্তমান ২৪ হাজার মেগাওয়াট থেকে ৪১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। এই উৎপাদনের বেশিরভাগই আসবে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। উৎপাদনের কেবল একটি ছোট্ট অংশ আসবে কার্বন মুক্ত পারমাণবিক উৎস ও আঞ্চলিক বিদ্যুৎ আমদানি থেকে।
এর মানে হল, যতক্ষণ না বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জলবিদ্যুৎ নিয়ে আসতে পারছে, বা অলৌকিকভাবে কয়েকটি নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারছে কিংবা নাটকীয়ভাবে বনাঞ্চল বৃদ্ধি করতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গ্লাসগোতে দিয়ে আসা কার্বন নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
গত সপ্তাহে গ্লাসগোর কপ-২৬ সম্মেলনে পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন জানিয়েছেন, ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড ডিস্ট্রিবিউশন (এনডিসি) অনুসারে দেশের কার্বন নির্গমনের ৫৫ শতাংশেরও বেশি আসে বিদ্যুৎ, পরিবহন, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও ইটভাটা ইত্যাদি খাত থেকে। কৃষি ও পশুসম্পদ থেকে নির্গত মিথেন দেশের মোট নির্গমনে অবদান রাখছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এরপরে রয়েছে কঠিন মানব বর্জ্য, যা মোট নির্গমনের ১৪ শতাংশের জন্য দায়ী। অবশিষ্ট অংশ আসে সিমেন্ট ও সার শিল্প থেকে।
বাংলাদেশ যদি এসব ক্ষেত্রে দ্রুতই কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে দেশের নির্গমন গিয়ে ঠেকবে ৪০৯ মিলিয়ন টনে। এসব খাত থেকেই বাংলাদেশ নির্গমন কমিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে চায়।
মাল্টি-সেক্টরাল চ্যালেঞ্জসমূহ
এই সুচিন্তিত উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য পূরণে মাল্টি-সেক্টর পলিসি পেপারগুলো জরুরিভিত্তিতে পুনরায় র্নিধারণ করা প্রয়োজন। এরপর প্রতিটি খাতেই যেমন- বিনিয়োগ, নতুন প্রযুক্তি ও সবুজায়নের জন্য অবকাঠামো তৈরিতে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। এগুলো মোকাবেলা করতে হবে যথাযথভাবে।
২০৩০ সালের মধ্যে সরকার ৪ হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখছে। এর অর্ধেকই সংযুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে। ব্যাপারটি খুবই চ্যালেঞ্জিং, কারণ মাত্র ১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হয় তিন একর জমি। সুতরাং এই লক্ষ্য এখনও মোট শক্তি উৎপাদনের একটি ছোট্ট অংশ।
সম্প্রতি সরকার ১০টি পরিকল্পিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাদ দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল, বাঁশখালী ও অন্যান্য স্থানে এক ডজনেরও বেশি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হবে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট।
সেইসঙ্গে এলএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত আরও কিছু নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পও স্থাপন করা হবে।
যদিও সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে কয়লাই সবচেয়ে বেশি দূষণীয়, তবে শক্তি উৎপাদনের অন্যান্য বিকল্পগুলোও খুব একটা পরিবেশবান্ধব নয়। কয়লা থেকে নির্গমনের স্কোর ১০ হলে, প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি থেকে নির্গমনের স্কোর হবে ৬।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ২০২৪ সাল থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান দেবে। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে সময় লাগে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বছর। তাই ২০৪০ সালের আগে সরকার আরেকটি পরিবেশবান্ধব পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে পারবে, এটি আশা বৃথা।
শক্তি উৎপাদনে পুরো বিশ্ব এখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক শক্তির দিকে ঝুঁকছে। মূলত এই কারণেই বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী চীন ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৫০টি পারমাণবিক চুল্লি তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিকল্প হলো নেপাল, ভুটান ও ভারতের জলবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এ নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলেছে দীর্ঘ আলোচনায়। এখানে মূল চ্যালেঞ্জ হলো, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের যোগান।
বাংলাদেশের সামনে আরেকটি বিকল্প হতে পারে সাশ্রয়ী মূল্যের ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’। এটি বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত। তবে গ্রিন হাইড্রোজেনের উন্নয়ন এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া আরেকটি বিকল্প হলো, যদি সৌর শক্তি প্রযুক্তিতে এমন কোনো অগ্রগতি হয়, যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সামান্য জমির প্রয়োজন হবে; তাহলেই আমরা নিজেদের ভাগ্যবান বলতে পারব।
বৈদ্যুতিক যানবাহনের দিকে যেতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন
শক্তি উৎপাদন ব্যতীত, বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী হলো যানবাহন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে একটি বড় পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। কারণ এই সময়ের মধ্যে ১০ হাজার হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক যানবাহন আসবে দেশে।ব্রডগেজ ও ইলেকট্রনিক লোকোমোটিভ চালু হবে; সেইসঙ্গে ভালো মানের জ্বালানি এবং ইউরো থ্রি ও ফোর টাইপ ইঞ্জিনের চলা শুরু হবে। এছাড়া সমস্ত হাইওয়েতে থাকবে চারটি করে লেন; পাশাপাশি রাস্তা থেকে ৮৬ হাজার অযোগ্য যানবাহন উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং সব ধরনের মোটরসাইকেল ও গাড়িতে ব্যাবহৃত হবে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি।
তবে দেশের রাস্তা থেকে প্রচলিত যানবাহন সরিয়ে, সেই জায়গায় বৈদ্যুতিক যানবাহন আনতে প্রয়োজন হবে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের। কারণ এর জন্য নির্মাণ করতে হবে বিশাল অবকাঠামো। সুতরাং, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাস্তা থেকে পুরোনো যানবাহন রাতারাতি উঠিয়ে নেওয়া অসম্ভব। বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩৫ সালের আগে পেট্রোলিয়াম চালিত যানবাহনের স্থান নিতে পারবে না বৈদ্যুতিক যানবাহন।
এক্ষেত্রে আমরা এখন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে ইটের ভাটা মোকাবেলায় মনোযোগ দিতে পারি। ২০২৪ সালের মধ্যে সরকার তার প্রকল্পগুলো থেকে পরিবেশ দূষণকারী সমস্ত প্রচলিত ইট ভাটা বাদ দেওয়ার নীতি নিয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
শিল্প, বাণিজ্যিক, গৃহস্থালি ও কৃষি খাত থেকে নির্গমন কমাতে সরকার ছয়টি ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম (সিডিএম) প্রকল্পের মাধ্যমে অংশীদারদের চাপ দেবে। এই প্রকল্পের আওতায় সরকার উন্নত মানের ছয় মিলিয়ন রান্নার চুলাও বিতরণ করবে।
কৃষি খাতে ধান ক্ষেত, সার প্রয়োগ ও সার ব্যবস্থাপনা থেকে মিথেন নির্গমন কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
মানব বর্জ্য থেকে নির্গমন কমাতে ঢাকায় বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য একটি প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। সেইসঙ্গে, শহরে একটি ইনসিনারেশন বা বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার প্ল্যান্ট নির্মাণ ও একটি আঞ্চলিক সমন্বিত অবর্জনার ভাগাড় তৈরির পাশাপাশি রিসোর্স রিকভারি বা সম্পদ পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনাও করেছে সরকার।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০৩০ সালের মধ্যে বনাঞ্চল বৃদ্ধি করতে চায় ২৪ শতাংশে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমান বনাঞ্চলের পরিমাণ ২২.৩৭ শতাংশ। এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়।
অবশেষে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনাগুলো প্রশংসা করার মতো। কারণ আমরা সবাই একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য নির্গমন কমাতে চাই। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কেবল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বড় বিনিয়োগ নয় বরং সমস্ত অংশীদারদের অংশগ্রহণ ও আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন হওয়া প্রয়োজন।