করোনা-পরবর্তী জটিলতা এখন নীরব ঘাতক

করোনা-পরবর্তী জটিলতা এখন নীরব ঘাতক

রাজবংশী রায়

জামালপুর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হীরক কুমার দাশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন গত মার্চে। পরে তিনি সেরেও ওঠেন। কিন্তু কিছু দিন পর দেখা দেয় শারীরিক নানা জটিলতা। এক পর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ৩০ মে রাতে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিডনি জটিলতা ধরা পড়ে। পরদিন ৩১ মে রাতে তার মৃত্যু হয়। একইভাবে গত জানুয়ারির শুরুতে করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ইসরাত জাহান তন্বী। সংক্রমণমুক্ত হলেও নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় ১৬ জানুয়ারি তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান।
এ দুই কর্মকর্তার মৃত্যুর খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু করোনা-পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যুর খবর অধিকাংশই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তাদের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত এসব মৃত্যু কেন হচ্ছে, কীভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে না।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ করোনা রোগীর পরবর্তী জটিলতা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সংক্রমিত থাকার সময় প্রয়োগ করা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে অনেকের সমস্যা হয়। করোনামুক্ত হলেও অধিকাংশ রোগীর ফুসফুসের সংক্রমণ ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনামুক্ত হওয়ার তিন মাস পরও ৪০ শতাংশ রোগী নানা জটিলতায় ভুগছেন। এ ধরনের ৫০০ রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে প্রায় ২০০ জনের কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, নাকে গন্ধ কম পাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কিডনি, লিভারজনিত জটিলতা পাওয়া গেছে। বয়স্কদের মধ্যে জটিলতার হার বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা ৮৭ হাজার করোনা রোগী এবং ৫০ হাজার সুস্থ ব্যক্তির তথ্য বিশ্নেষণ করে জানতে পেরেছেন, সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যু ৬০ শতাংশ বেশি। খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে এ-সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা করোনা সংক্রমণের পরবর্তী ছয় মাসকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভোগা রোগীদের কথা বিবেচনা করে গত আগস্টে পোস্ট কভিড ইউনিট চালু করা হয়েছে। গত তিন মাসে এই ইউনিটে তিন হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, এসব থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেতে চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণা চালানো প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

গত আগস্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও পোস্ট কভিড ইউনিট চালু হয়। সেখানেও প্রায় আড়াই হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এই ইউনিটে রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুলুর হক বলেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের জটিলতা ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী বেশি। শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আগে এ সমস্যা ছিল না। করোনা সংক্রমণে ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া কিডনি, লিভার, নিউরো, উচ্চ মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, খাবারে অরুচি ও দুর্বলতা নিয়ে রোগীরা পোস্ট কভিড ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসছেন। অধিকাংশ রোগী দীর্ঘদিন ধরে জটিলতায় ভুগছেন।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. সাইদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, করোনা-পরবর্তী অধিকাংশ রোগীর ফুসফুসের কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ায় রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছায় না। অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে রোগীর কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। এ অবস্থাকে পালমোনারি ফাইব্রোসিস বলা হয়। এতে ফুসফুসের নরম অংশগুলো নষ্ট হয়ে যায়, ক্ষত সৃষ্টি হয়, ফুসফুসের টিস্যু মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফুসফুসে বাতাসের থলিগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এ জন্য করোনামুক্ত হওয়ার পরও নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রয়োজন। যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু হতে পারে।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর যেসব জটিলতা দেখা দেয়, তা কাটিয়ে উঠতে অনেকের সময় লাগে। অবশ্য কেউ কেউ দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারেন। এটি নির্ভর করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর।
তিনি আরও বলেন, করোনা সংক্রমণে সৃষ্ট জটিলতা কতদিন থাকে, তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে। দু-একটি গবেষণার প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির শারীরিক জটিলতা তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতায় থাকা রোগীরা হাসপাতালে গেলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। চিকিৎসায় সংশ্নিষ্টদের প্রতি আহ্বান থাকবে, এ ধরনের রোগীদের যেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য