মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সরকারি দল আওয়ামী লীগকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ব্যবস্থায় বিষয়টি কৌশলেই মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। দুদেশের বিদ্যমান ‘বহুমাত্রিক সম্পর্ক’ বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানান পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখায় মনোযোগী দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা। তবে মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞায় দেশের রাজনীতিতে বা আন্তর্জাতিক মহলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে অনেকের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, পরে তারাই আবার সম্পর্ক করেছে। তবে সরকার এমন নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা বিব্রত। নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করা হয়েছে। তবে তা ‘সিস্টেমেটিক ওয়েতে’ হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় হতাশা জানানো হয়েছে। এতে উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও বিষয়টি জেনে-বুঝে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভা অনুষ্ঠিত হয় দলের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয় ধানমন্ডিতে। সভায় যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে।
বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের এ বিজয়ের মাসে যুক্তরাষ্ট্রের যে বক্তব্য, সেটা দেশের জঙ্গিবাদ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং সন্ত্রাসীদের উৎসাহী করবে। মূল কথা হচ্ছে এটা।’
এই নিষেধাজ্ঞার কোনো প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে কি না- জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘র্যাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে বক্তব্য দিয়েছে, তা নিয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। এ নিয়ে আমরা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। তবে এতে দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমাদের নির্বাচনে তার প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের নির্বাচন আমরাই করব, এখানে কি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে নির্বাচন করব?’
যদিও গত রবিবার ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের দ্বারপ্রান্তে এসে র্যাবের সাবেক ও বর্তমার সাত কর্মকর্তাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এমন একটি সিদ্ধান্তে (নিষেধাজ্ঞা আরোপ) আমরা বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছি।’ তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন জনগণ আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছে। তাই আমি বিশ্বাস করতে চাই, তারা সব সময় আমাদের পাশে থাকবেন। তার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।’
র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা অনভিপ্রেত, দুঃখজনক, অগ্রহণযোগ্য, অকার্যকর বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গত রবিবার তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটেছে কি না বা বহু আগে ঘটেছে কি না সেটি আমার জানা নেই। কোনো পূর্ব যোগাযোগ ছাড়া হঠাৎ করে এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী হয়েছে কি না, সেটিও একটি বিষয়। আমরা আশা করব, আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সেন্টিমেন্ট অনুধাবন করতে সমর্থ হবে।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। কিন্তু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনকারী ইসরায়েলের কোনো কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা যায়নি। অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সম্পর্ক যুক্ত সেখানে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আমরা দেখিনি।’
তবে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মি আহমেদ। গতকাল সন্ধ্যায় তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক আলোচনা শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, ওই সিদ্ধান্ত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে হয়েছে কি না। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, হতে পারে। তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন একটা ঢং। র্যাব এবং এই সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’ এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে নানাপর্যায়ে আরো আলোচনা চালিয়ে যাব।’
এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতেই নারাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মাঝেমধ্যেই এমন করে থাকে। আর কেনই বা এমনটা করে, তা তারাই জানে। আমাদের দেশের মিডিয়া এটাকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না।’
এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘তবু তারা আমাদের নিয়ে বলেছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটি কয়েকটি কারণে হয়ে থাকতে পারে।’ বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারও এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণ হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের সুস্পষ্ট একটি প্রাধান্য রয়েছে। এই অঞ্চলে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া দেখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কোন রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে দিচ্ছে? রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার বা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি, যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র বলে মনে করে না। চাপ সৃষ্টি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এটি ব্যবহার করে।’
তিনি আরো বলেন, তারা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও একসময় এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আবার তারাই এখন তাকে ডেকে নিচ্ছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ারই দরকার নেই। আর এমন নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও খারাপ হবে না।
এ বিষয়ে ‘বাংলা সিনেমা’র মতো উত্তেজিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় রাজনীতি অথবা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটি বড় কোনো সমস্যা বলে আমার মনে হয় না। তবে এই ঘোষণাটি সরকারের জন্য বিব্রতকর। এ বিষয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে চাপ প্রয়োগ (প্রেশার ক্রিয়েট) করলে তেমন কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।’ কিন্তু তারা যেহেতু এ ধরনের অভিযোগ দিয়েছে সে বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে আবারও একবার আলাপণ্ডআলোচনার পক্ষে মত দেন তিনি।”