গোপনে গ্যাস সংযোগ

গোপনে গ্যাস সংযোগ

আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ। ফলে ৫৬ হাজার আবেদনকারী আবেদন করেও বৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ পাচ্ছেন না। টাকাও ফিরে পাচ্ছেন না। অথচ পর্দার আড়ালে গ্যাস সংযোগ চলছে। এরই মধ্যে অতি গোপনে আবাসিক ৯৪৫ গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ গ্যাস সংযোগ দেয়ার নেপথ্যে কে? কত টাকা লেনদেন হয়েছে পর্দার আড়ালে?

জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে ইনকিলাবকে বলেন, আমার ডিজিটালাইজেশন করছি। এ সময় আগের গ্রাহক যারা তালিকায় আসেননি তাদের তালিকায় আনা হচ্ছে। এভাবে তালিকটি বড় হচ্ছে। আমরা নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা জারির পর ৯৪৫ জন গ্রাহকে আবাসিক গ্যাস সংযোগ দিয়েছে সেটা আমার জানা নেই। সকল নাগরিক সমান সুবিধা দেওয়া দেয়া হচ্ছে। আবেদনকারী গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের বিপরীতে টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে।

২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য রাজধানীর ৫৬ হাজার আবেদনকারী গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের বিপরীতে নেওয়া প্রায় ৪১ কোটি টাকা তিতাসে জমা। এর পরে আবাসিক এলাকায় নতুন গ্যাস সংযোগ ২০১৯ সালের ২১ মে মাস থেকে আবাসিক, সিএনজি এবং গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে জ্বালানি বিভাগ। পরে গত জুলাই মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে ফেরত দিতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কেম্পানি লিমিটেড। তা এখনো ফিরে দিতে পারছে না।

এরপর বিভিন্ন সময়ে আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে ডিমান্ড নোটের টাকাও ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু এ নির্দেশনা জারির পর গত একটি অর্থবছরে ৯৪৫ জন গ্রাহকে গোপানে আবাসিক গ্যাস সংযোগ। অন্যান্য গ্রাহকরা জানার পরে এসব তথ্য অকপটে স্বীকার করেছেন তিতাস। এই স্বীকারোক্তির পর প্রশ্ন উঠেছে দ্বৈত নীতি কেন? কেউ পাবে তো কেউ পাবে না, এমন আচরণ বন্ধ করে সকল নাগরিককে সমান সুবিধা দেওয়ার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই অতি গোপানে এই কাজ করেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাও সংযোগ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিতাস এর আগে তদন্ত করে এমন অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে। ওই তদন্তে দেখা গেছে কোনও কাগজপত্র ছাড়াই কয়েক হাজার গ্রাহকের নাম ডাটাবেজে এন্ট্রি করে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। আবার একটি চুলার জন্য ৫ লাখ এবং দুই চলার জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে সংযোগ দিচ্ছে। ফলে গ্রাহক ওই সিন্ডিকেটের কাছে টাকা দিলেই সে বিল দিয়ে গ্যাস ব্যবহার করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, তিতাসের গ্যাস লাইনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভেতরে ভেতরে গ্যাস সংযোগ ঠিকই দিচ্ছে কিছু শ্রেণির মানুষকে। তাদের তালিকায়ও যুক্ত করে দিচ্ছে গোপনে। প্রতিবেদন আসলে সবাই তো দেখবে না, জানবেও না। প্রতিবছর যে বাড়ছে সে হিসেব তো রাখছে না। সেই সুযোগটিই এইখানে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, নিয়মের ব্যত্যয় এখন সব জায়গায়। কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে সুবিধা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ আজীবন ভোগান্তির শিকার হয়।

তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিতাসের মোট সংযোগ ছিল ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৩০২টি। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৭টি। সরল হিসেবে এ সংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৪৫টি। এতো গোপনীয়তার মধ্যেও ৯৪৫ জন গ্রাহক কারা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ হিসাবটি গত জুন পর্যন্ত। ফলে এরমধ্যেও আবার গ্রাহক বেড়েছে কিনা বলা মুশকিল। সরকারের নির্দেশের অবজ্ঞা করে এ গ্রাহক বৃদ্ধি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিতাসের আবাসিক সংযোগ ছিল ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৫টি যা ৪৬ হাজার ৬৪৯টি বেড়ে ২০১৭-১৮-তে হয়েছে ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৭টি। এ চিত্র পরের অর্থবছরগুলোতেও বজায় ছিল। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা হয়েছে ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯টি। অর্থাৎ বিগত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮ হাজার ৮৮৩টি। অর্থাৎ হাজার হাজার সংযোগ বেড়েছে। কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই অতি গোপানে এ কাজ করেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাও সংযোগ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

তিতাস এর আগে তদন্ত করে এমন অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে। ওই তদন্তে দেখা গেছে কোনও কাগজপত্র ছাড়াই কয়েক হাজার গ্রাহকের নাম ডাটাবেজে এন্ট্রি করে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। আবার একটি চুলার জন্য ৫ লাখ এবং দুই চলার জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়ে সংযোগ দিচ্ছে। ফলে গ্রাহক ওই সিন্ডিকেটের কাছে টাকা দিলেই সে বিল দিয়ে গ্যাস ব্যবহার করছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের পর থেকেই আবাসিকে সংযোগের বিষয়ে কঠোরতা ছিল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে ওই সময় কারও সংযোগ পাওয়ার কথা ছিল না। জ্বালানি বিভাগ থেকে ওই সময় মৌখিকভাবে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিক সংযোগ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় প্রতি বছরই এই শ্রেণির সংযোগ বেড়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে বিষয়টি মেনেও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির এ কার্যক্রম বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছালে জ্বালানি বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়।

২০১৯ সালের মে মাসে সরকার নতুন সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করলে ৫৬ হাজার আবেদনকারীর এসব ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত দিতে তিতাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ ছিল। এ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টাকা ফেরত দিতে তিতাসকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ। এর চার মাস পর অর্থ ফেরত দিতে গত ২ মে তিতাসের ভিজিল্যান্স শাখার মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে তিতাস।

২০০৯ সালে গ্যাস সংকটের কথা বলে প্রথম দফা আবাসিক সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে ফের আবাসিকের সংযোগ চালু করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জ্বালানি বিভাগ থেকে অলিখিতভাবে বিতরণ কেম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালের ২১ মে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। যদিও ২০১৩ থেকে ২০১৯ অবধি ডিমান্ড নোটের টাকা জমা নিয়েছে বিতরণ কেম্পানিগুলো।

জাতীয়