গ্রাহকদের টাকা আটকে রেখে তা সরিয়ে ফেলাই ধামাকা শপিং ডটকমের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে আগেই জানিয়েছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ( র্যাব)। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়িসহ নানাভাবে সাধারণ ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করত। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনেও একই রকম তথ্য উঠে এল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন মার্চেন্ট ও গ্রাহক ৪৭০ কোটি টাকা পাবে। এ অর্থ পরিশোধ না করেই উল্টো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হিসাব থেকে ১২৯ কোটি ৭৬ লাখ ৪৩২ টাকা তুলে নিয়েছেন ধামাকা শপিং ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসীম উদ্দিন চিশতী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধামাকার গ্রাহকরা বিভিন্ন পণ্যের জন্য যে অর্থ পরিশোধ করেছিলেন তা লুটপাট করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা ও তাদের স্বজনরা। মার্চেন্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পণ্য সরবরাহ ছাড়াই শুধু কাগুজে লেনদেন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার আশঙ্কার কথাও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধারণা, এসব কাজে ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মো. সিরাজুল ইসলাম ও তার ভাই মো. সেলিম হোসেনসহ আরো অনেকেই সম্পৃক্ত। সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের আইনি প্রক্রিয়ায় আনা গেলে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন সহজ হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ধামাকা শপিংয়ের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক সরেজমিনে এ বিশেষ পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, লোভনীয় বিভিন্ন ডিসকাউন্ট অফারের ব্যবসা ছিল ধামাকা শপিং ডটকমের। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম হয় ধামাকার। ফলে শেষ পর্যন্ত মূলধন খোয়াতে হয় তাদের। এতে ধামাকা শপিংয়ের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ৩০৩ কোটি ও মার্চেন্টদের পাওনা ১৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গ্রাহক ও মার্চেন্ট মিলিয়ে ধামাকার কাছে মোট পাওনা ৪৭০ কোটি টাকা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে এ বিপুল পরিমাণ দেনা থাকলেও ধামাকা শপিংয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে মাত্র ৪৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা দেনার বিপরীতে ধামাকার রয়েছে মাত্র ৯ পয়সা।
প্রতিবেদন উল্লেখ করা তথ্য পর্যালোচনা করে আরো দেখা যায়, বিভিন্ন হিসাব থেকে জসীম উদ্দিন চিশতী ১২৯ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ার নামে তিনি তুলে নেন ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ৩১ হাজার ১৪২ টাকা। এছাড়া সফটওয়্যার কেনার নামে স্থানান্তর করেছেন ২০ কোটি টাকা। এর বাইরে চিশতী নিজের অ্যাকাউন্টে ধামাকা শপিং থেকে ৮৪ কোটি ১০ লাখ ২৯০ টাকা সরিয়ে নিয়েছেন, যা তিনি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাবে কোনো সমন্বয় করেননি।
ধামাকার সঙ্গে গ্রাহকের মোট ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৮ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে। গ্রাহকের ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৪টি ক্রয়াদেশের বিপরীতে এ পরিমাণ লেনদেন হয়। এর মধ্যে ধামাকা শপিং ডটকম কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৭২টি ক্রয়াদেশের অনুকূলে পণ্য সরবরাহ করেছে, টাকার অংকে যার পরিমাণ ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকা। অগ্রিম টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি ৩০২ কোটি ৯৯ লাখ ৫৪ হাজার ২৩২ টাকার, যা গ্রাহকের অনুকূলে ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের অপরিশোধিত বকেয়া দায়।
অন্যদিকে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন মার্চেন্টের সঙ্গে ধামাকা শপিংয়ের পণ্য সরবরাহ বাবদ মোট লেনদেন হয়েছে ৭২৪ কোটি ৫৭ লাখ ২২ হাজার ৫৫৪ টাকার। তবে ধামাকা কর্তৃপক্ষ ওইসব পণ্য বিভিন্ন হারে ডিসকাউন্ট অফারে বিক্রি করেছে মাত্র ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকায়। এভাবে ক্রেতা টানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক লেনদেনে ৩২২ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৮ টাকার ঘাটতি পড়েছে। তবে এর মধ্যেই মার্চেন্টদের পণ্য সরবরাহের বিপরীতে বকেয়া মোট ৫৫৭ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার ২১১ টাকা পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রক্রিয়ায়
ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের কাছে মার্চেন্ট বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনো অপরিশোধিত বকেয়া রয়ে গেছে ১৬৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টাকার।
দেশে একের পর এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট ধামাকাসহ নয়টি ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হালনাগাদ তথ্য চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা, ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে মোট দায়ের পরিমাণ, চলতি ও স্থায়ী মূলধনের পরিমাণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য কোথাও অর্থ সরিয়ে থাকলে তার তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ধামাকা শপিংয়ের বিষয়ে এ সরেজমিন বিশেষ পরিদর্শন চালায়।
মার্চেন্ট বা পাওনাদার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুটি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তারা দেখতে পেয়েছে, মার্চেন্টদের পাওনা ১৬৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টাকার মধ্যে এ দুটি হিসাবে পণ্যের অর্ডার বাবদ ধামাকা শপিং থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি বড় অংশ বিক্রেতারা পণ্য সরবরাহের পরিবর্তে গ্রাহকদের নগদ ও চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ কাগুজে ক্রয়-বিক্রয় হলেও কোনো পণ্য বিনিময় হয়নি। প্রাথমিকভাবে ধামাকা শপিংয়ের কাছ থেকে ডিসকাউন্ট সুবিধা ভোগ করেছেন এমন কিছু গ্রাহক দফায় দফায় বিক্রেতাদের কাছ থেকে নগদ ও চেকের মাধ্যমে অর্থ ফেরত পেয়েছেন। ওই সুবিধাভোগীদের সঙ্গে ধামাকা শপিং বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন বলে মত দেয় তদন্ত দল।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুবিধাভোগী গ্রাহকদের একজন হলেন মো. সেলিম হোসেন। তার বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনি ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মো. সিরাজুল ইসলামের ভাই। সে কারণেই সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিদর্শক দলটির সদস্যরা। তারা মনে করছেন ধামাকা শপিং, পণ্যের পরিবর্তে অর্থ হস্তান্তরকারী অসাধু বিক্রেতা ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা গেলে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন আরো সহজ হবে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশও করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের প্রধান এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটি আমরা পর্যালোচনা করব। এর পরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে শুধু ধামাকা শপিংয়েই মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয় বলে জানান এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার।
ধামাকা শপিংয়ের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কোম্পানিটির রেজিস্টার্ড গ্রাহক ছিল দুই লাখেরও বেশি। প্রায় ১১ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কোম্পানিটিতে পণ্য সরবরাহ করেছে। ধামাকা শপিং মূলত ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের ই-কমার্স ব্যবসা। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম মাইক্রোট্রেড গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। এ গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলজিস, মাইক্রোট্রেড ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ও মাইক্রোট্রেড আইসিএক্স লিমিটেড।