৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনায় ২০১১ সালের আগস্টে প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। আর ইঞ্জিনগুলো কেনায় চুক্তি সই হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। এরপর সোয়া তিন বছরেও ঋণের ব্যবস্থা হয়নি। যদিও ১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের কথা ছিল। দুটি প্রতিষ্ঠান ঋণপ্রস্তাব দিলেও কঠিন শর্তের ঋণের কারণে তা নিয়ে আপত্তি তোলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
এদিকে তিন বছর পেরোনোয় ইঞ্জিনের দাম ১৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম। কিন্তু সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি রেলওয়ে। উল্টো সহজ শর্তের ঋণ সংগ্রহের কথা বলা হয়। এতে ৭০ ইঞ্জিন সরবরাহের চুক্তি বাতিল করতে চিঠি দিয়েছে হুন্দাই রোটেম। পাশাপাশি চুক্তির সময় জমা দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টিও ফেরত চেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিটি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হুন্দাইয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে রেলওয়ে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আজ রেলভবনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভা আহ্বান করা হয়েছে।
বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ঋণ চুক্তি না হওয়ায় বাণিজ্যিক চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এতে প্রকল্পের অগ্রগতি খুবই কম (০.৫%)। প্রকল্প সাহায্য খাতে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। শুধু প্রশাসনিক কাজ সম্পাদনে জিওবি খাতে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র ০.২%।
তথ্যমতে, প্রকল্পটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) একনেকে অনুমোদনের সময় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণের ব্যবস্থা করা) বা অন্য কোনো সহজ শর্তের উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইঞ্জিনগুলো কেনায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করেও গ্রহণযোগ্য দরদাতা পাওয়া যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে তৃতীয় দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। আর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।
দরপত্রের সঙ্গে প্রাপ্ত ঋণপ্রস্তাবটি নিয়ে দরকষাকষি ও চুক্তি সইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণে তা ইআরডিতে পাঠানো হয় ২০১৮ সালের জুনে। দরকষাকষির এক পর্যায়ে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি ও আগস্টে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভায় প্রস্তাবটি নিয়ে দুই দফা
আলোচনা হয়। পরে বিভিন্ন দপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে গত ৪ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় ইআরডি।
এতে বলা হয়েছে, ‘কোরিয়ান কোম্পানি কর্তৃক প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকার কর্তৃক এত উচ্চহার সুদে অনমনীয় গ্রহণের পরিবর্তে কোরিয়ান সরকারের নমনীয় উৎসের বা অন্য কোনো উৎসের নমনীয় প্রকৃতির ঋণ সংগ্রহ করা বাঞ্চনীয় হবে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ নভেম্বর হুন্দাই রোটেমকে চিঠি দিয়ে সহজ শর্তের ঋণ সংস্থানের প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে সে প্রস্তাবে অনাগ্রহ প্রকাশ করে হুন্দাই। এর পরিবর্তে চুক্তি বাতিল ও চুক্তির সময় জমা দেয়া এক লাখ ১৫ হাজার ডলারের ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরতের অনুরোধ করে কোম্পানিটি।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পিআইসি সভা আহ্বান করা হয়েছে। পাশাপাশি সহজ শর্তের ঋণ বা জিওবি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইআরডি সচিবকে অনুরোধ করতে পত্র দেয়া অথবা পুনরায় দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সভায়। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পটির ডিপিপি দ্বিতীয় দফা সংশোধন করতে হবে।
জানতে চাইলে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, চুক্তি বাতিলের বিষয়ে হুন্দাইয়ের প্রস্তাবটি নিয়ে পিআইসি সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। এর ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ৭০টি ইঞ্জিন কেনার চুক্তিমূল্য ছিল ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ডলার বা দুই হাজার ৩৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এজন্য বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড (এসসিবি) ও জাপানের সুমিতোমো মিটসুই ব্যাংকিং করপোরেশন (এসএমবিসি) কঠিন শর্তে ঋণ দিতে চেয়েছিল। আর ইঞ্জিনগুলো কেনায় মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। তবে বর্তমান অবস্থায় ইঞ্জিনগুলো কিনতে গেলে ব্যয় বেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও বর্তমানে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছেন রেলের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, ২০১০ সালে রেলের ইঞ্জিন সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। তবে এরই মধ্যে রেলের বহরে ৪১টি মিটারগেজ ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে। ফলে ওই প্রকল্পটি এখন আর দরকার নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পটি বাতিল করা উচিত। এর পরিবর্তে ২০টি ইঞ্জিন কিনলেই চলবে। এজন্য পৃথক প্রকল্প নেয়াই উত্তম।
উল্লেখ্য, ৭০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৩০টি সম্পূর্ণ ফিটিং অবস্থায় কেনার কথা ছিল। বাকিগুলোর মধ্যে ২৫টি অর্ধ-উš§ুক্ত (হাফ নকডাউন) ও বাকি ১৫টি পুরো উম্মুক্ত অবস্থায় (ফুল নকডাউন) কেনা হতো। এ ইঞ্জিনগুলো দেশে এনে রেলের নিজস্ব ওয়ার্কশপে সংযোজন করা হবে।