দেশে নারকেল তেলের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড প্যারাসুট। শুধু তেল নয়, চুলের কালি থেকে বিভিন্ন প্রসাধনী কী নেই জনপ্রিয় পণ্যের তালিকায়। প্রতি বছর এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে বাংলাদেশে ব্যবসা করে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড। সরকারের দেয়া সব সুবিধা গ্রহণ করে পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিটি দেশের আইনের কোনো তোয়াক্কাই করে না। যার প্রমাণ হলো রেয়াত জালিয়াতি।
রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্রতিষ্ঠানটির জালিয়াতির শেষ নেই। কখনও একই বিল অব এন্ট্রিতে দুবার রেয়াত নিয়েছে। আবার কখনও একই প্রতিষ্ঠানের নামে দুই জায়গা থেকে নিয়েছে রেয়াত। কখনও এক দপ্তরে নিবন্ধিত পণ্যের বিপরীতে রেয়াত নিয়েছে দুই জায়গা থেকে। আবার আমদানি কাঁচামালের বিপরীতে দুই জায়গা থেকে নিয়েছে রেয়াত।
ভারতীয় ম্যারিকো লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের মতো স্বনামধন্য কোম্পানির জালিয়াতিতে হতবাক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দেশে কোম্পানিটির দুটি কারখানা ও একটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে পৃথক তিনটি মূসক নিবন্ধন রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় অনুযায়ী কোম্পানির একটি নিবন্ধন থাকার কথা। আবার তিনটি প্রতিষ্ঠান হলেও সিএ রিপোর্ট করা হয় একটি। যার ফলে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা করা যায় না। ফলে ম্যারিকোর মোটা দাগের ফাঁকি উদ্ঘাটন কখনও করতে পারেনি এনবিআর। এ ছাড়া তিনটি নিবন্ধন হওয়ায় রেয়াত জালিয়াতি রোধ সম্ভব হচ্ছে না। চেষ্টা করেও প্রতিষ্ঠানকে শতভাগ মূসক আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্রমতে, গাজীপুরে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের দুটি কারখানা ও একটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে গাজীপুরের মৌচাকের ফ্যাক্টরি বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে মূসক নিবন্ধিত। বাকি একটি ফ্যাক্টরি ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একই কাঁচামাল এলটিইউ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে রেয়াত নেয়ার অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এলটিইউকে নির্দেশ দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ’র একটি দল প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের মাসিক রিটার্ন (দাখিলপত্র), কাঁচামাল আমদানি ও ভ্যাট-সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলাদি যাচাই করে প্রতিবেদন দেয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ছয় মাসে স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা কাঁচামালের ওপর জালিয়াতি করে ভ্যাট ঢাকা উত্তর ও এলটিইউ থেকে প্রায় ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত রেয়াত নিয়েছে। আবার দুটি প্রতিষ্ঠানের বিল অব এন্ট্রি ব্যবহার করে আমদানি করা কাঁচামালে প্রায় ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত রেয়াত নিয়েছে। আবার একই বিল অব এন্ট্রি ব্যবহার করে অতিরিক্ত আগাম কর সমন্বয় করেছে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আবার একটি বিল অব এন্ট্রি থেকে দুবার পর্যন্ত রেয়াত নিয়েছে। শুধু তাই নয়, কর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আইন লঙ্ঘন করে আমদানি করা কাঁচামালে রেয়াত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আইন অনুযায়ী, চার করমেয়াদ বা চার মাস পর রেয়াত ওই পণ্যে রেয়াত নেয়া যায় না। মাত্র ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি মূসক আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ রেয়াত ও অতিরিক্ত আগাম কর সমন্বয় করেছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, অবৈধ রেয়াত ও আগাম কর সমন্বয় করায় প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে এলটিইউ। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ রেয়াত নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেছে বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। মাত্র ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির এই জালিয়াতিতে হতবাক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, একই প্রতিষ্ঠান অথচ দুই জায়গা থেকে অবৈধ রেয়াত নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পুরো বছরের হিসাব করা গেলে অবৈধ রেয়াত নেয়ার পরিমাণ কয়েকগুণ বের করা সম্ভব হবে।
সূত্র জানিয়েছেন, ঢাকা উত্তর কমিশনারেটে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিন্তু রেয়াত নেয় এলটিইউ থেকে-এমন জালিয়াতিও উদ্ঘাটন করেছে এলটিইউ। তাতেও অবৈধ রেয়াত নেয়া, একই বিল অব এন্ট্রি ব্যবহার করে অবৈধ রেয়াত, অতিরিক্ত আগাম কর সমন্বয় করার মতো জালিয়াতি উদ্ঘাটন করে এলটিইউ। পরে এলটিইউ কর্মকর্তারা পৃথক প্রতিবেদন দেন। যাতে দেখা যায়, ম্যারিকোর হানিকম্ব, প্যারাসুট কোকোনাট অয়েল ইত্যাদি পণ্য ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের পণ্য। কিন্তু রেয়াত নেয়া ও আগাম কর সমন্বয় করা হয়েছে এলটিইউতে। মাসের মাসিক রিটার্ন (দাখিলপত্র), কাঁচামাল আমদানি ও ভ্যাট-সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলাদি যাচাইয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে উত্তর কমিশনারেটে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ওইসব পণ্যে এলটিইউ থেকে স্থানীয় কর চালানের মাধ্যমে অবৈধ রেয়াত নিয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ টাকা।আবার ওই কমিশনারেটে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিল অব এন্ট্রি ব্যবহার করেছে অবৈধ রেয়াত নিয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আগাম কর সমন্বয় করেছে প্রায় এক কোটি ৯ লাখ টাকা। এছাড়া ওই কমিশনারেটের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ও রিসার্চ সেবার ওপর নেয়া হয়েছে অবৈধ রেয়াত। তিন মাসে অবৈধ রেয়াত ও আগাম কর সমন্বয় করেছে প্রায় ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এলটিইউ ও ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট এ দুই জায়গা থেকে এসব রাজস্ব জালিয়াতি করেছে। অবৈধ রেয়াত ও আগাম কর সমন্বয় করায় প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে এলটিইউ। তাতে প্রতিষ্ঠান একই জবাব দেয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু অভিযোগ যাচাই করছে এলটিইউ।
কর্মকর্তারা বলছেন, ম্যারিকো একটি বহুজাতিক কোম্পানি। ম্যারিকো ভারত থেকে বাংলাদেশে কাঁচামাল আমদানি করে। সেই কাঁচামাল আবার বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিমাণ দাম দেখানো হয়। বিষয়টি নিয়েও তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। আবার প্রতিষ্ঠানটি এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় কাঁচামাল স্থানান্তরে কস্ট দেখায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, যেখানে কস্ট হওয়ার কথা ১ থেকে ২ শতাংশ। মূলত মূসক ফাঁকি ও অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ করতে প্রতিষ্ঠানটি এই অস্বাভাবিক কস্ট দেখায় বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ গোপালের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াইসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়ার পরও কোনো জবাব দেননি। এ বিষয়ে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ইলিয়াস আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মামলার বিষয়ে আমি জানি না। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দেন।
উল্লেখ্য, মুম্বাইভিত্তিক এফএমসিজি কোম্পানি ম্যারিকো ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। গাজীপুরের মৌচাক ও সিরিরচালায় অবস্থিত ম্যারিকোর কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে নেপালে রপ্তানি হচ্ছে। ম্যারিকোর আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যবসার ৪৯ শতাংশই আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বাজারে ম্যারিকোর রাজস্ব আয়ের ৬৫ শতাংশই আসে প্যারাসুট ব্র্যান্ডের নারকেল তেল থেকে। ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৯০ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক বছরে শেয়ারহোল্ডারদের ৯০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে। সর্বশেষ এ কোম্পানিটির শেয়ার দুই হাজার ৩১৫ টাকা ৫০ পয়সায় কেনাবেচা হতে দেখা গেছে।