এটিএম কার্ড জালিয়াত চক্রের সদস্য জার্মানির নাগরিক টমাস গিরাট উইচ ওরফে পিওতর সিজোফেন মুজারেক জামিন নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছেন। দুই বছর আগে আদালত থেকে জামিন নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। তাঁকে ধরতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।
এদিকে আদালতে ২০১৯ সালের শেষ দিকে জমা দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছে, কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে পিওতর সিজোফেন বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে পিওতরের আইনজীবী এইচ এম মাসুমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, পিওতর তাঁকে কিছু না বলেই দুই বছর আগে এ দেশ ছেড়েছেন। এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
কার্ড জালিয়াতির মামলার বিচার চলাকালে একজন বিদেশি নাগরিক দেশ ছাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটিএম কার্ড জালিয়াতির আলোচিত মামলায় গ্রেপ্তার একজন বিদেশি নাগরিকের জামিন নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। আদালত স্থানীয় জামিনদারদের কারণ দর্শানোর নোটিশও করতে পারেন। এসব আসামির ক্ষেত্রে পুলিশের আরও নজরদারি বাড়ানো উচিত।
ইতিমধ্যে পিওতরকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে আদালত আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন।
এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে প্রায় ছয় বছর আগে (২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি) পিওতরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজধানীর বনানী থানায় দায়ের করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় জালিয়াতিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
জালিয়াতির অভিযোগে পিওতরের বিরুদ্ধে গুলশান ও বিমানবন্দর থানায় আরও দুটি মামলা করা হয়। তিন মামলাতেই ২০১৯ সালের মে মাসে তিনি আদালত থেকে জামিন পান।মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জার্মানির নাগরিক পিওতরের প্রকৃত নাম গিরাট উইচ। ২০১৪ সালে তিনি পোল্যান্ডের পাসপোর্টে দেশে আসেন। নিজের নাম দেন পিওতর সেজোফেন। প্রথমে তিনি গুলশানের একটি হোটেলে ওঠেন। পরে একই হোটেলে ওঠেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ফরিদ নাভির।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পিওতর বলেন, ফরিদ নাভির তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কিন্তু কিছুদিন পর ফরিদ হোটেল ছাড়লেও, পিওতর হোটেল ছেড়ে যাননি। তিনি তাঁর বাংলাদেশি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে প্রায় ৮ মাস হোটেলে থাকেন।
এদিকে আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পিওতর ঢাকার মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবীরের মাধ্যমে এ দেশ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ২৭৮ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে জানা গেছে, পিওতর বাংলাদেশ থেকে কোটি টাকা পাচার করেছেন।
সিটিটিসির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পিওতর গ্রেপ্তার হওয়ার আগপর্যন্ত (২০১৪-১৬) তাঁর চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩ জন গ্রাহকের এটিএম কার্ডের নম্বর ও পাসওয়ার্ড চুরি করেন। পরে তাঁদের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়। সিটিটিসি ১৩ জন গ্রাহকের নাম, কার্ড নম্বর, কোন এটিএম বুথ থেকে কত টাকা তোলা হয়েছে, তা আদালতকে দেওয়া প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, কার্ড জালিয়াতিতে পিওতরের সহযোগী ছিলেন দুজন বিদেশি। একজন বুলগেরিয়ার ডিমিটার রোমিও, অন্যজন ইউক্রেনের জেলেস্কি এন্ড্রি। পিওতর, রোমিও ও এন্ড্রি ভিন্ন ভিন্ন সময় বনানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথে প্রবেশ করতেন। এরপর তথ্য সংগ্রহের জন্য এটিএম কার্ডের প্রবেশপথে স্কিমিং ডিভাইস বসাতেন। আর পাসওয়ার্ড সংগ্রহে এটিএমের কি-বোর্ডের ওপর বসাতেন ভিডিও ক্যামেরা।
মামলার সাক্ষী ও এটিএম বুথের নিরাপত্তারক্ষী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান কার্যালয়ের লোক পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাঁদের এটিএম বুথে ঢোকেন। পরে জ্যামিতি বক্সের মতো দেখতে একধরনের যন্ত্র বসিয়ে চলে যান। এরপর গ্রাহকের অজান্তে চক্রটি টাকা তুলে নেওয়ার সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছিল।
এ রকম একজন ভুক্তভোগী ইদ্রিস আলীর ৪০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেশায় আমি একজন চাকরিজীবী। সেদিন অফিসে বসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলে মেসেজ আসে। দেখি, আমার অ্যাকাউন্ট থেকে ৪০ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানাই। অবশ্য ব্যাংক পরে আমার এটিএম কার্ডের লেনদেন স্থগিত করে এবং আমাকে ৪০ হাজার টাকা ফিরিয়ে দেয়।’
কার্ড জালিয়াতি নিয়ে পিওতর যা বলেছেন
কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ফরিদ জড়িত ছিলেন বলে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে দাবি করেন পিওতর। তবে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে ফরিদের জড়িত থাকার তথ্য বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেছে পুলিশ।
পুলিশ আদালতকে লিখিতভাবে আরও বলেছে, জালিয়াতির ঘটনায় পিওতর খান এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক তাওহীদুল ইসলাম খানের নামও বলেছিলেন। তবে তদন্তে তাঁর জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। পিওতর গুলশান থানার তৎকালীন পরিদর্শক ফিরোজ কবীরের নামও উল্লেখ করেন। তবে এটিএম থেকে টাকা চুরি করার ভিডিও ফুটেজে ফিরোজের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞাপন
জালিয়াতির ঘটনায় আমিন জুয়েলার্স, আরিয়ানা ট্রাভেলস, ফাহিম মিউজিকের মালিকসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিটিটিসি। তবে তাঁদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির আসাদুজ্জামান বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। জালিয়াতিতে যাঁদের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।