নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভোটের আগে প্রকাশ্যে শামীম-আইভী দ্বন্দ্ব

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভোটের আগে প্রকাশ্যে শামীম-আইভী দ্বন্দ্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা

 

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আর মাত্র সাত দিন বাকি। এ সময় নির্বাচনে শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আওয়ামী লীগের নেতারাই। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শামীমের বিরুদ্ধে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও আইভীর পক্ষে প্রচারে দেখা যায়নি নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শামীমপন্থী নেতাদের। এ নিয়ে জল্পনার শেষ নেই নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারদের। তবে শুরু থেকেই এ নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন আইভী।

কিন্তু গত শুক্রবার শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির নেতারা তৈমুরের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামার পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে আইভীর। গতকাল শনিবার তিনি প্রকাশ্যেই অভিযোগের তির দেগেছেন শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে যে শামীম ওসমানকে বড় ভাই সম্বোধন করেছিলেন, গতকাল সেই শামীমকে গডফাদার হিসেবে আখ্যায়িত করে আইভী বলেছেন, ‘তৈমুর আলম খন্দকার গডফাদার শামীম ওসমান ও

সেলিম ওসমানের প্রার্থী। উনি বিএনপির প্রার্থী না, স্বতন্ত্র প্রার্থী না; তিনি ওসমান পরিবারের প্রার্থী।’ আইভীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শামীম-আইভীর চিরায়ত দ্বন্দ্ব আবারও প্রকাশ্য হলো।

এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংসদ শামীম ওসমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি নিজের অবস্থান তুলে ধরবেন।

শুধু আইভী নন, সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। তাঁরা বলছেন, শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর তদন্ত চলছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে শামীমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই হুঁশিয়ারি যে কথার-কথা নয় তারও ইঙ্গিত মিলেছে গতকাল। নির্বাচনে আইভীর পক্ষে প্রচারে নিষ্ক্রিয়তার দায়ে গতকাল নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। অবশ্য কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এ কমিটি ভাঙা হয়েছে। যদিও নগর কমিটির সঙ্গে একই দিনে গঠন করা নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি এখনো বহাল রয়েছে। নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ, সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন হাসনাত রহমান বিন্দু শামীম ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, শুধু ছাত্রলীগ নয়, নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে যেসব সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তা পাওয়া যাবে সেসব কমিটিই বিলুপ্ত করা হবে।

আইভীর অভিযোগ: এবারের সিটি নির্বাচন ঘিরে শামীম ওসমানের নানামুখী তৎপরতার খবর শোনা গেছে। আইভীর বিপক্ষে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছিলেন শামীমের তিন অনুসারী। কিন্তু দল শেষ পর্যন্ত আইভীর হাতে নৌকা তুলে দেওয়ার পর সিটি নির্বাচন নিয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করতে থাকেন শামীম। এরপরই জোর প্রচার শুরু হয়, আইভীকে ঠেকাতে শামীম ওসমানই তৈমুরকে ভোটের মাঠে নামিয়েছেন। তবে আইভী শুরু থেকেই এ নিয়ে মুখ খোলেননি। নৌকার প্রচারে শামীমের নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে আইভী বলেছিলেন, ‘তিনি (শামীম ওসমান) আমার বড়ভাই, তিনি একজন এমপি। এমপি হওয়ার কারণে উনি প্রচারে আসতে পারবেন না। যেহেতু তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী, শেখ হাসিনার কর্মী সেহেতু তিনি নৌকার বাইরে যাবেন না। তিনিও কিন্তু নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করেন।’

কিন্তু গত শুক্রবার বন্দর এলাকায় তৈমুরের প্রচারে অংশ নেন নবনির্বাচিত চারজন ইউপি চেয়ারম্যান। তাঁরা সবাই শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে তাঁরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তৈমুরের প্রচারে এই চারজনের উপস্থিতি বদলে দিয়েছে নানা সমীকরণ। স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে তৈমুরের প্রতি ওসমান পরিবারের সমর্থন অনেকটাই প্রকাশ্য হয়েছে।

গতকাল বন্দর এলাকার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচারে গিয়ে আইভী বলেন, ‘আমি আজকে স্পষ্টভাবে বলতে চাইছি, তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপির প্রার্থী না। সে গডফাদার শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানের প্রার্থী। শামীম ওসমান তাঁকে প্রার্থী করেছে। যদি সে বিএনপির প্রার্থী হতো তাহলে সে ধানের শিষ নিয়ে নামতো। আর ধানের শিষের সঙ্গে আমার এই চাচা থাকত না। উনি নৌকার আইভীকে বেছে নিত না। উনি গডফাদারের প্রার্থী, শামীম ওসমানের প্রার্থী। নতুন করে আবার উত্থান হতে শুরু করেছে।’

আইভী আরও বলেন, ‘শুক্রবারের প্রচারণায় আপনারা দেখেছেন, সেখানে সাংসদ সেলিম ওসমানের অনুসারী চার ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এতে প্রমাণিত হয়, সারা নারায়ণগঞ্জে কয়েক দিন ধরে যে গুঞ্জন ছিল—তৈমুর আলম খন্দকার গডফাদার শামীম ওসমানের প্রার্থী—সেটি প্রমাণিত হয়েছে।’

তবে এ জন্য মনোবল হারাচ্ছেন না আইভী। উল্টো শক্তভাবে সবাইকে মোকাবিলা করার ঘোষণা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের অপশক্তি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গডফাদার, সন্ত্রাসীদের যেভাবে শক্ত হাতে দমন করেছি ঠিক একইভাবে দন্তবিহীন বাঘকে শক্ত হাতে দমন করতে চাই। আমরা হাতিকেও দমন করতে চাই, সন্ত্রাসীকে দমন করতে চাই। আমার পাশে আসুন। আমাকে ভোট দিন, সাপোর্ট করুন।’

যা বললেন শামীম: আইভীর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় শামীম ওসমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে তিনি (আইভী) বললেন, আমি তাঁর বড়ভাই, আওয়ামী লীগের সাংসদ। দুই দিনের মধ্যে গডফাদার হয়ে গেলাম? আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে আমার দল। আমি যদি গডফাদার হই; তাহলে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন কে? কাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো? যে বলেছে, তাঁর (আইভী) কাছে জিজ্ঞেস করেন আপনি দুই দিন আগে এটা বলেছেন, দুই দিন পরে এটা বললেন। কোনটা সঠিক।’

এসব অভিযোগ নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান তুলে ধরবেন জানিয়ে শামীম বলেন, ‘প্রথম দিক থেকেই চুপচাপ ছিলাম। এখনো আছি। তাহলে আমি নিউজ হব কেন? আমি তো তাঁদের (কেন্দ্রীয় নেতা) বলেছি, আমার কারণটা কী। তারপরও ওনারা ফায়দা লুটতে চাইলে এখন আমার দায়িত্ব জনগণকে সব জানানো। জনগণ যদি সেটা সঠিক মনে করে, তাহলে সঠিক। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত বিষয়, কোনো রাজনৈতিক নয়।’

ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় নেতারা: শামীমের ওসমানের ভূমিকা নিয়ে শুরু থেকেই অসন্তুষ্ট নারায়ণগঞ্জে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তাঁর (শামীম ওসমান) কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজের প্রমাণ পেলে দল বসে থাকবে না। তাঁর কিছু লোকজন বসে আছে। হয়তো দু-একজন গোপনে বিরোধিতা করছে। প্রকাশ্য পাওয়া যাচ্ছে না।’ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ থাকলে আইভীকে তা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দেওয়ার পরামর্শ দেন মির্জা আজম। আইভীর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘শামীম ওসমান গডফাদার নাকি গডফাদার নন-সেটা নারায়ণগঞ্জের মানুষ জানে। এটা আমাদের পর্যবেক্ষণের বিষয় না। কারণ তিনিতো আমাদের দলীয় সাংসদ।’

এদিকে গতকাল নারায়ণগঞ্জে এক মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিই এই নির্বাচনে (নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন) কোনো অবস্থাতেই অপরিহার্য নন। যার কথা বলা হচ্ছে (শামীম ওসমান) তিনি একটা দলের আদর্শ-নীতি-শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং লালন করেই এত বড় নেতা হয়েছেন।’

দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা প্রসঙ্গে আবদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব খবর আসছে সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। উনি (শামীম) আমাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন নিশ্চিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প থাকবে না। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নেতা বলেন, ‘যেহেতু শামীম ওসমান দলীয় সাংসদ। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা প্রধানমন্ত্রীই নেবেন। তাঁকে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সকল ঘটনা জানানো হচ্ছে।’

রাজনীতি সারাদেশ