নিজস্ব প্রতিবেদক
অবশেষে ভোটারদের শঙ্কাই সত্যি হলো। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের ১১টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) চেয়ারম্যান পদে ভোট হচ্ছে না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় ১১ ইউপিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এর আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মনোহরগঞ্জের এই ইউনিয়নগুলোতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য পদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম কিনতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। এর আগে এই দুই উপজেলায় স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বেশ কয়েকটি নির্বাচন হয়নি। বিনা ভোটেই আওয়ামী লীগের নেতারা এসব এলাকায় জনপ্রতিনিধি হয়েছেন।
চেয়ারম্যন ছাড়াও মনোহরগঞ্জের এই ১১ ইউপিতে সাধারণ সদস্য (মেম্বার) ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের ১৪৩টি পদের মধ্যে ১২৯টিতেই বিনা ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের মধ্যে সাধারণ সদস্যের ৯৯টি পদে ৮৮ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের ৩৩টি পদের মধ্যে ৩০ জন বিনা ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন। কেবল বিপুলাসার ইউনিয়নের ৯টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৩টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড, মৈশাতুয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ও ঝলম উত্তর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে একাধিক প্রার্থী থাকায় ওই ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচন হবে।
আজ বৃহস্পতিবার এই উপজেলার ১১টি ইউপিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল। ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপে এই উপজেলায় ইভিএমে ভোট গ্রহণের দিনক্ষণ নির্ধারণ আছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, কুমিল্লা-৯ (লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ) আসনের সাংসদ মো. তাজুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি মনোহরগঞ্জ উপজেলার ঝলম দক্ষিণ ইউনিয়নের পোমগাঁও গ্রামে। মন্ত্রী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সদস্যও তিনি। গত তিন বছরে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, লাকসাম পৌরসভা নির্বাচন, লাকসাম উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে কোনো ভোট হয়নি। বিনা ভোটেই আওয়ামী লীগের নেতারা এসব এলাকায় জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। এবার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১ ইউনিয়নে সব চেয়ারম্যানও বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক মমিনুল হক চৌধুরী আজ বিকেলে বলেন, ‘এভাবে নির্বাচনের নামে বিনা ভোটে জয়ী হওয়া গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি। নিজেদের অন্তর্কোন্দল ঠেকাতে সরকার বা দল এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়, এটা কোনো সুস্থ রাজনীতি নয়। দলীয়ভাবে বিনা ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে দলের লোকের পক্ষে কাজ করবেন। তিনি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করবেন। এতে করে গ্রামীণ জনপদের সব মানুষ সরকারের নানা ধরনের উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমার মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনোহরগঞ্জ ও লাকসামের উদাহরণ ভালো কোনো বার্তা বহন করছে না।’
মন্ত্রীর এলাকায় এবারও বিনা ভোটে ১১ আ.লীগ নেতা চেয়ারম্যান
কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মনোহরগঞ্জে ১১টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ১৬ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৪০ জন ও সাধারণ সদস্য পদে ১৩৮ জন মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন। বাছাইয়ে সবার প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। আজ চেয়ারম্যান পদে বাইশগাঁও ইউনিয়নে দুজন এবং লক্ষণপুর, হাসনাবাদ ও সরষপুরে একজন করে পাঁচজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত ১১ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সবাই জয়ী হন।
এদিকে ১১টি ইউনিয়নে সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের ৩৩টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪০ জন। এর মধ্যে ১০টি ইউনিয়নে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী থাকায় ভোট হচ্ছে না। শুধু বিপুলাসার ইউনিয়নের তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে সাতজন প্রার্থী আছেন।
সাধারণ সদস্যের ৯৯টি পদের মধ্যে ৮৮টি ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী থাকায় ভোট হবে না। কেবল বিপুলাসার ইউনিয়নের ৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৩৩ জন প্রার্থী রয়েছেন। মৈশাতুয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে দুজন ও ঝলম উত্তর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দুজন প্রার্থী রয়েছেন। অর্থাৎ ৩ ইউনিয়নে ১১টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৩টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নির্বাচন হচ্ছে। এতে প্রার্থীর সংখ্যা ৪৪ জন।
বিনা ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের ১১ জন চেয়ারম্যান হলেন নাথেরপেটুয়া ইউপিতে আবদুল মান্নান চৌধুরী, বিপুলাসারে ইকবাল হোসেন, ঝলম উত্তরে আবদুল মজিদ খান, ঝলম দক্ষিণে আশিকুর রহমান হাওলাদার, উত্তর হাওলা ইউপিতে আবদুল হান্নান, খিলায় আল আমিন ভূঁইয়া, মৈশাতুয়ায় মফিজুল ইসলাম, বাইশগাঁওয়ে আলমগীর হোসেন, লক্ষণপুরে মহিনউদ্দিন চৌধুরী, হাসনাবাদে কামাল হোসেন ও সরসপুর ইউপিতে আবদুল মান্নান।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. নাজির হোসেন মিয়া বলেন, চেয়ারম্যান পদে কোনো ভোট হচ্ছে না মনোহরগঞ্জে। সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদের ১৪টি ওয়ার্ডে ভোট হবে। এখানেও বেশির ভাগ পদে ভোট হচ্ছে না।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে কেউ প্রার্থী না হলে আমরা কী করব? আমাদের দলের যাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে বিভিন্ন পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’