শীত মৌসুম এলেই ঢাকার বায়ুদূষণ বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে প্রতি বছর। চলতি মৌসুমে সে দৃশ্যপটে এসেছে বড় পরিবর্তন। এবার ভারতের রাজধানী দিল্লিকে ছাড়িয়ে বিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছে ঢাকা। ২৩ জানুয়ারি থেকে টানা তিনদিন বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা। জানুয়ারিতে একদিনও রাজধানীবাসীর ভাগ্যে জোটেনি নির্মল বায়ু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবে অনিয়ন্ত্রিত বায়ুদূষণ দিনদিন ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলেই মন্তব্য করেছেন তারা।
সরকারের একাধিক সংস্থা বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখলেও দূষণ রোধে সমন্বিত কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে না। তবে বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তরকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে নিয়মিত চিঠি দেয়া হচ্ছে। সে চিঠিতে বায়ুদূষণ রোধে খোলা ট্রাকে বালি পরিবহন না করা, নির্মাণাধীন ভবন ঢেকে রাখা, নিয়মিত পানি ছিটানোর কথা বলা হলেও যথাযথভাবে নির্দেশনা মানছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়ে বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে বলতাম। আমাদের কথা না শোনার ফলে এখন সে নির্দেশনা মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সে নির্দেশনাও যথাযথ মানা হচ্ছে না।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারিতে একদিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। বায়ুদূষণের জন্য তিনটি বিষয়কে প্রধানত দায়ী করা হয় শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ এবং যানবাহনের ধোঁয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসিক এবং বাণিজ্যিক নির্মাণকাজ বৃদ্ধির ফলে মারাত্মকভাবে বেড়েছে বায়ুদূষণ। বায়ু গবেষকরা বলেন, নির্মাণকাজের জন্য প্রতিনিয়ত ট্রাকভর্তি বালি ঢুকছে রাজধানীতে। খোলা ট্রাকের বালু বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুদূষণ করছে। এছাড়াও গাড়ির চাকার ঘর্ষণে বালি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে বাতাসে মিশে নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক বাড়িয়ে তুলছে।
ওই গবেষণায় বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২১—এ ছয় বছরের জানুয়ারির বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গড় হিসাবে বায়ুমান সূচক ছিল ২১৯ দশমিক ৫২। বায়ুমান সূচক ২০০ অতিক্রম করলেই তা খুবই অস্বাস্থ্যকর বিবেচনা করা হয়। ঢাকা শহরের ১০টি স্থানে গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, প্রতিটি স্থানের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে গড় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ২০২১ সালে ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল তেজগাঁও এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম) এবং পরের অবস্থানে রয়েছে শাহবাগ এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)।
গবেষণা অনুযায়ী, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি ৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২—এ এলাকাগুলোতে গড় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ ছিল প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১, ৬৬ এবং ৬৫ মাইক্রোগ্রাম এবং যা নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ আছে। তবে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের জনবল কম থাকায় ঠিকঠাক মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। গত দুই মাসে রাজধানী ও এর আশপাশে ১৮টি অভিযান পরিচালনা করে অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ। এতে ৮১টি ইটভাটাকে ৬ কোটি, বেশ কয়েকটি নির্মাণাধীন ভবনকে ৯ লাখ এবং কয়েকটি স্টিল মিলকে ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরিবেশবিদরা বলছেন, দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান মোটেও যথার্থ নয়। এজন্য অধিদপ্তরকে অবশ্যই অন্যান্য সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রম সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের বর্তমান যে সক্ষমতা আছে তা দিয়ে পরিবেশ ও বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম আরো জোরালো হওয়া উচিত।
রাজধানীর বায়ুদূষণে বড় ভূমিকা পালন করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়িগুলো। বিশেষ করে বর্জ্য বহনের সময় বর্জ্যবাহী যানগুলো খোলা থাকে। বহনের সময় যে বর্জ্য রাস্তায় পড়ে যায়, সেগুলো পচে বায়ুদূষণ করে থাকে। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের ভেতর যেসব নির্মাণাধীন কাজ হয়, বিশেষ করে আবাসিক এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলেও বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। তবে সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জোরালোভাবে বলেছেন। তিনি বলেন, মেট্রোরেলসহ বড় প্রকল্পগুলোর নির্মাণকাজের ফলে মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, বায়ুদূষণ রোধে আমরা সপ্তাহে দুই দিন দূষণপ্রবণ এলাকায় পানি ছিটিয়ে থাকি, তবে তা যথেষ্ট নয়। ওয়াসা থেকে পানি কিনতে হয় বলে পানির খরচ আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুল মোতালেব বলেন, বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে দূষণ রোধ সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সবাই আন্তরিক হলেই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।