৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত। ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ের একটি বাসের ভেতর নারী ও শিশুদের আর্তচিৎকার। হাত চোখ বাঁধা কেউ চিৎকার করলে মারধরের মাত্রাও বেড়ে যায়। টানা তিন ঘণ্টা হাইওয়েতে বাসের মধ্যে যাত্রীদের নারকীয় নির্যাতন করেছে ডাকাতদল। করেছে নারীদের যৌন নির্যাতনও। তারপর নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেছে অপরাধীরা।
সেদিনের সেই নারকীয় ঘটনায় বাসের যাত্রী ছিলেন টাঙ্গাইলের যুবক নাইম খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, রাত ৮টার দিকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিয়াকৈর যাওয়ার জন্য একটি খালি বাসে উঠি। পথে আরও ৩০ জনের মতো যাত্রী ওঠে। পাকুল্লা বাজারের কাছাকাছি এলে ১০ জনের মতো লোক অস্ত্র উঁচিয়ে সবার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলে। প্রায় তিন ঘণ্টা হাইওয়েতে বাস নিয়ে ডাকাতদল ঘোরাঘুরি করে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়। প্রত্যেককে মারধর করে। মাঝে মধ্যে নারীদের চিৎকার ভেসে আসছিল। চোখ বাঁধা থাকায় বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর মধ্যরাতে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে বাস থামিয়ে ডাকাতরা চলে যায়।
নাইম খান বলেন, ঘটনার পর দিন তিনি থানায় অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ প্রথমে তার অভিযোগ নেয়নি। এমনকি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন। পরে থানার ওসি অভিযোগ নেন।
এ রকম ডাকাতির ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর মহাসড়কের ৩৮টি স্পটে অন্তত ১২টি চক্র নিয়মিত ডাকাতি করছে। অধিকাংশ ঘটনায় মামলা হয় না। হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মামলা দিতে পেরেছেন ভুক্তভোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় এক থানায় মামলা করতে গেলে ঠেলে অন্য থানায় পাঠিয়ে দেয়। বিশেষ করে চলতি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় ‘ঘটনাস্থল আমার এলাকায় নয়’ দাবি করে মামলা নেয় না থানা পুলিশ। থানার ঠেলাঠেলিতে অতিষ্ঠ অনেক ভুক্তভোগী হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত মামলাই করেন না। আবার প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ কিংবা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর কিছু মামলা হয়। গত দুই মাসে হাইওয়েতে চারটি বাস ডাকাতির ঘটনা অনুসন্ধান করে আমাদের সময় দেখেছে ঘটনার পরপরই থানায় গিয়েও মামলা করতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। থানা থানায় ঘুরতে হয়েছে। পরে প্রভাবশালীদের তদবির কিংবা ঊর্ধ্বতন পুলিশের হস্তক্ষেপে মামলা নিতে বাধ্য হয় স্থানীয় থানা পুলিশ।
গত ৯ জানুয়ারি ঢাকার সাভারে ডাকাতির শিকার হয়ে ঘটনার পরপরই আব্দুল্লাহ আল-মামুন নামে এক যুবক মামলা করতে গেলে তা নেয়নি পুলিশ। ঘটনার ২৪ দিন পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি নিয়েছে সাভার থানা পুলিশ। পর দিন ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আশুলিয়া থানায় বাস ডাকাতির আরও একটি মামলা হয়। মামলার বাদী জুয়েল নামে এক বাসচালক। তবে ডাকাতির ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় দুই মাস আগে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে তিনি টাঙ্গাইল থেকে কালিয়াকৈর আসার পথে ডাকাতির কবলে পড়া নাইম খান পরের দিন থানায় গেলেও অভিযোগ নেয়নি পুলিশ। আলোচিত টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিকুল থানায় মামলা করতে না পেরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ঘটনার ৯ দিনের মাথায় তার মামলা নেয় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, ডাকাতির ঘটনা একটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন তা নির্ধারণে বড় পরিমাপক। থানার ওসিকে প্রতি সপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে হয়। ডাকাতির ঘটনা সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হয়। তাই ডাকাতির মতো ঘটনা মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ। ডাকাতির ঘটনায় দস্যুতার মামলা কিংবা হারানোর জিডি নিয়েই দায়িত্ব শেষ করে তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় ঘটনা এক থানা থেকে শুরু হয়ে আরেক থানা এলাকা বা দূরের কোনো থানা এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। এই অবস্থায় থানা পুলিশের মধ্যে মামলা নেওয়া নিয়ে ঠেলাঠেলি করার প্রবণতা দেখা যায়। এটি দূর করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ঘটনার শুরু হয়েছে যে এলাকায় সেই এলাকার থানা পুলিশকে মামলা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাইওয়েতে ডাকাতি বন্ধে ১৮ দফা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ডাকাত ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের সমন্বিত অভিযান শুরু করবে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (ক্রাইম) হায়দার আলী খান আমাদের সময়কে বলেন, মামলা না নেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। প্রতিটি থানায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে। কোনো থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। হাইওয়ে পুলিশের লজিস্টিক সাপোর্ট আরও প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাইওয়ের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও জনবল কম। হাইওয়েতে গাড়ি চলে ১০০ কিমি বেগে। আমাদের গাড়ি সেই গতিতে চলতে পারে না। সাধারণ মানুষ বা যাত্রীদের কোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে পুলিশের সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
তবে গাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় অনেকেই থানা পর্যন্ত যান না। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গত বছরের ২৯ এপ্রিল প্রাইভেটকারে ডাকাতির শিকার হয়েছিলেন রনি নামে এক ব্যক্তি। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ডাকাত তার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগের টাকা নেওয়ার পাশাপাশি কার্ড দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলেও নিয়েছিল। তবে তিনি থানায় কোনো অভিযোগ করেননি।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরিচিতজনদের কারও ডাকাতি হওয়া অর্থ উদ্ধার হতে দেখিনি। পুলিশের কাছে গেলে ঝামেলা। ঝামেলায় যেতে চাইনি।
হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিওনের এসপি আলী আহমেদ খান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা শুধু হাইওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত করি। ডাকাতির ঘটনার তদন্ত করে স্থানীয় থানা পুলিশ। হাইওয়েতে ডাকাতি বন্ধে নিয়মিত পেট্রলিং করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এক রুটের বাস যাতে অন্য রুটে না চলে সেটা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছে পুলিশ। সম্প্রতি কয়েকটি বাস জব্দ করাও হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা হাইওয়েতে অপরাধ কমিয়ে আনতে কাজ করছি।
উত্তরা পশ্চিম থানার একটি মামলাসহ সাভার, আশুলিয়া, মির্জাপুর ও টাঙ্গাইল সদর থানায় দায়ের সাতটি ডাকাতির মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোন। টাঙ্গাইলের চিকিৎসক শফিকুল ইসলামের ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ডাকাত চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। ডাকাত সদস্যদের একাধিক সদস্য বিভিন্ন গ্রæপে বিভক্ত হয়ে বাসে ডাকাতি করে বেড়ায়। এর মধ্যে একটি বাসে ডাকাতির সময় দুই তরুণীকে ধর্ষণও করে বলে গ্রেপ্তারের পর ডাকাতরা স্বীকার করেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা জানান, ডাকাতির ঘটনায় একাধিক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। এখনো কয়েকজন ডাকাত পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী ৩৮ স্পটে ডাকাতি : মহাসড়কে বাসে ডাকাতির ক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোকে বেছে নিচ্ছে অপরাধী চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের এলেঙ্গা, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, কবিরপুর, বাইপাইল, নবীনগর, সাভার, হেমায়েতপুর, গেন্ডা, আশুলিয়া, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, ধামরাই, কামালপুর, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, কাঁচপুর, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ রুটে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে বেশি। এসব স্থানে অন্তত ১২টি চক্র ডাকাতিতে সক্রিয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই একজন কর্মকর্তা জানান, এসব রুটে ডাকাতির ঘটনায় যতগুলো রিপোর্ট হয়েছে তার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি। অনেক সময় ডাকাতরা গ্রেপ্তারের পর ঘটনার কথা স্বীকার করলেও খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মামলা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডাকাতির বন্ধে ১৮ সিদ্ধান্ত : মহাসড়কে বা বাসে ডাকাতি বন্ধে সমন্বিত অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ সমন্বয় করে কাজ করবে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেও ডাকাত সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স¤প্রতি বাসে ডাকাতির একাধিক ঘটনায় তোলপাড় হলে পুলিশ সদর দফতর, হাইওয়ে পুলিশ, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একাধিক বৈঠক করে ডাকাতি বন্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছে।
বৈঠকগুলোতে উপস্থিত থাকা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ডাকাতি বন্ধে তারা প্রতিটি বাসে পুশ বাটন নামে একটি ইলেকট্রিক ডিভাইস লাগানোর পরিকল্পনা করছেন। যাতে বাসে ডাকাত সদস্যরা হানা দিলে ওই বাসটিকে সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শনাক্ত করতে পারে। একই সঙ্গে বাসগুলোতে জিপিএস লাগানো, আইপি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা, হাইওয়ে পুলিশের পেট্রলিং বাড়ানো, দূরপাল্লার বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের ভিডিও করে রাখার কার্যক্রম জোরদার, যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নাম্বার সংরক্ষণ করা, ডাকাতদের একটি সমন্বিত ডাটাবেস তৈরি করা, বাসের রুট পারমিট চেক করা। ডাকাতরা সাধারণত বাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ঘুরে বেড়ায়। এক্ষেত্রে এক রুটের বাস অন্য রুটে দেখলে চেক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।