আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই কর্মপরিকল্পনা সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিরোধীদের বিষয়গুলো বিবেচনা করেই তৈরি করা হচ্ছে রোডম্যাপ। তবে টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে তৃণমূলের কোন্দল-অস্থিরতা, অগোছালো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, শীর্ষ নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার মতো বিষয়। তবে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে এসব সমস্যা নিরসন করে সর্বোপরি দলকে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সভা সূত্রে জানা গেছে, টানা তৃতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সরকার সারা দেশে যে ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছে, সে কারণে আগামী নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগে আস্থা রাখবে। কারণ গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগ যে পুরো বাংলাদেশকেই পাল্টে দিয়েছে, এটা আওয়ামী লীগের চরম সমালোচকরাও স্বীকার করেন। আর সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগ এখন অন্য যেকোনো দলের চেয়ে শক্তিশালী।
গত শনিবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আছে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় থাকবে। সংবিধানসম্মতভাবে যথাসময়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকে উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংগ্রামে জয় আমাদের হবেই।
তবে এসবের পরও নানা কারণে আওয়ামী লীগ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা খারাপ করেছেন। প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শতকরা ৭৩ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে শেষ দফায় এসে মাত্র ২৭ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য ভীষণ উদ্বেগের বলে মনে করছেন দলটির নেতারা। দলের হাইকমান্ডের বারবার নির্দেশনা দেওয়া পরও এই নির্বাচনে বিদ্রোহীদের থামানো যায়নি এবং এই বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ধরাশায়ী করেছে এবং এটির প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে বলে অনেকেই মনে করছেন।
কোন্দলে অস্থির তৃণমূল : ইউপি নির্বাচন ছাড়াও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যেই তৃণমূলে দেখা যাচ্ছে নানা রকম অস্থিরতা এবং বিরোধ। বিশেষ করে স্থানীয় নেতারা এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের কমা-ও মানছে না।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এমন চিত্র দেখা গেছে। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ভাই লীগ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করতে হবে। এরপরই বক্তব্য চলাকালে মাইকের শব্দ বন্ধ ও মাইক ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। মূলত স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এমপির দূরত্বের কারণে এমন ঘটনা ঘটে, যা গড়িয়েছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা পর্যন্ত। এ ঘটনায় অভিযোগও দেওয়া হয়েছে।
নেতারা বলেছেন, এ অবস্থা আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। দলের চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি যে সম্মান, শ্রদ্ধা ছিল সেটিও এখন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থা চললে সামনের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ হবে।
অগোছালো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন : আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা এখন অগোছালো। ছাত্রলীগ প্রতিনিয়ত নানা রকম বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় শ্রমিক লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কোন্দল অনেকটা প্রকাশ্যে এসেছে। সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও পরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপে সমাধান আসে। একসময় আওয়ামী লীগের শক্তির অন্যতম উৎস ছিল এসব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। এখন সেগুলোর জন্য আওয়ামী লীগকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যই মাঝেমধ্যে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নাম আসছে।
শীর্ষ নেতৃত্বে নিষ্ক্রিয়তা : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি বিরাট অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর হেভিওয়েট সদস্যের অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে অনেকের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। দিবস-বৃত্তি অনুষ্ঠানে তাদের দেখা মেলে।
মন্ত্রীর সঙ্গে ও দলীয় নেতার দূরত্ব : সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী দলের নেতা নন এবং দলের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেন না। তাদের অনেকে হাইব্রিড হিসেবে চিহ্নিত করেন। দলীয় নেতাদের অভিযোগ, এমন মন্ত্রীদের ফোন করলে তারা রিসিভ করেন না। কোনো বিষয়ে অনুরোধ করলেও পাত্তা পান না—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ফলে দলের সঙ্গে সরকারের যে সমন্বয়, সেই সমন্বয় অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় ঐক্যবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল। এই দল এখন সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। দু-একটি জায়গায় বিচ্ছুতি ঘটলেই সেখানে আমাদের দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দলের সাংগঠনিক বিচ্ছৃঙ্খলা রোধে আওয়ামী লীগ সব সময় কঠোর থাকে। তাই আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড কখনোই ভাঙবে না। এজন্য সম্প্রতি দলের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকে নেত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেকটি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে সশরীরে উপস্থিত থেকে ইউনিট, জেলা-উপজেলাপর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো সম্মেলনের নির্দেশ দিয়েছেন।’
দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য বলেন, ‘ছাত্রলীগ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের কল্যাণে কাজ করছে সংগঠনটি। জাতীয় শ্রমিক লীগের যেসব বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সেসব সমস্যার সমাধান হয়েছে। তার পরও যারা প্রশ্ন ওঠাতে চান, তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’