শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানীর চেয়ারম্যান শাহ আলম ও তার চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- দেলোয়ার হোসেন শিকদার, কাজী মানে উল্লাহ, সুমন মোল্লা ও আব্দুল হান্নান মোল্লা। শনিবার (১২ মার্চ) সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১ এর একটি দল নরসিংদীর জেলায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
র্যাব বলছে,মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতারণা করত শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানী। তিন শতাধিক মাঠকর্মীর মাধ্যমে ৫-৬ হাজার মানুষের কাছ থেকে দুই শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে জমি ও ব্যাংকে বিনিয়োগ এবং ব্যাংক লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। ফলে গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে সবাই আত্মগোপন যায়। বর্তমানে তাদের যে সম্পদ আছে, তা দিয়ে গ্রাহকের টাকা অর্ধেকও পরিশোধ করা যাবে না।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে রবিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে র্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নরসিংদীর শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে নেয়া হত আমানত। আর প্রতিষ্ঠানটিতে আমানত রাখতে হলে আগে দিতে হতো ধর্মীয় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস করলেই করা হতো সদস্য, নেয়া হতো আমানত। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে টাকা ফেরত চাওয়ার পরই আত্মগোপনে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। ভুক্তভোগীরা নরসিংদীর পলাশ থানায় একটি মামলা করেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়। এরপরই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যেভাবে প্রতারণা শুরু : গত ২০১০ সালে নরসিংদীর সদর থানার চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় শরিয়া ভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানী আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরে আড়ালে এমএলএম কার্যক্রম শুরু করে। সু-কৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদ মুক্ত ব্যবসার কথা বলে বিভিন্ন পেশার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। সাধারণ মানুষের মাঝে বিশ্বাস অর্জনের জন্য নেয়া হতো ধর্মের পরীক্ষা। সুদ মুক্ত জীবন মুনাফার ফাঁদে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি লোপাট করে প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে শাহ আলম চারটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ২৪ জন কর্মচারী ও ২০ জন পরিচালক নিয়োগ করা হয়। পরিচালকদের সবাই প্রতারক শাহ আলমের সহযোগীদের স্ত্রী, আত্মীয় স্বজন। প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে নরসিংদীর বিভিন্ন থানায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস ও কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- শাহ সুলতান এম.সি.এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি., স্বদেশ টেক্সটাইল লিমিটেড, শাহ সুলতান টেক্সটাইল লিমিটেড ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লিমিটেড।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে যা জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনশতাধিক কর্মী রয়েছে। যাদেরকে কোনো প্রকার বেতন দেয়া হতো না। গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে এককালীন ১০ শতাংশ ও বছরে ছয় শতাংশের প্রলোভন দেখানো হতো। আর বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক ১২-১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখা হতো। এছাড়াও তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি মুনাফায় মাসিকভিত্তিতে ডিপিএস এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত।
বেশ কিছু গ্রাহককে বেশি বা উচ্চ মুনাফায় লোন দেয়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতোই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান কার্যক্রম করেছিল। গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকায় জমি কেনা ও টেক্সটাইল মিলে (কারখানা) বিনিয়োগ এবং নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র বলেন, ইসলামিক কৌশলে কীভাবে প্রতারণা করছিল এমন প্রশ্নে কমান্ডার মঈন বলেন, ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা ও ইসলামিক কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই প্রতারণা করে আসছিল। সাধারণ মানুষের বিশ্বস্থতা অর্জনের জন্য তারা ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা নিতেন। ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক সবকিছু মেনে চলছেন কিনা এই বিবেচনায় গ্রাহকদের সদস্যপদ ও বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া হতো। এছাড়াও একটি নির্দিষ্ট জেলা কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং ওই এলাকায় ২০১০ সালের আগে তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকায় মানুষের বিশ্বস্থতার জায়গা অর্জন করেছে।
গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে কী করা হতো এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রাহকের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পারসেনটেন্স দেয়া হতো; বেতন দেয়া হতো না। আর নিজেদের নামে জমি কিনেছে ৷ পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে, আবার সেই ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিয়ে দুটি টেক্সটাইল মিল ও স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে একটি কোম্পানি খুলেছিল।
অন্য প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, শাহ সুলতানের চারটি প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক রয়েছে। তাদের তথ্য মতে, আরো অনেক টাকার প্রতারণা করেছে। তবে এই টাকাগুলো ব্যাংকে রাখেনি। প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের ২০ জন থাকলেও পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের তথ্য মতে, করোনাকালীন তারা লাভ করতে না পারায় গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের যে সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করল ৫০ কোটি টাকার মতো হবে।