যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনে অথচ ভোগ্যপণ্যের মূল্য হু-হু করে বাড়ছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে ভোজ্য তেল সয়াবিন নিয়ে বাজারে চলছে ‘তেলেসমাতি’ কারবার। একশ্রেণির অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে সয়াবিনসহ নিত্যপণ্যের বাজারে। সেখানে আবার আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে একশ্রেণির ‘ফটকাবাজ’ ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীও। তারা অধিক মুনাফার লোভে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল মজুদ করে লুকিয়ে রাখছে বাসা-বাড়ির কোনে, বাথরুমে, খাটের নিচে, মুরগির খামারে, মাটির নিচে বা বিভিন্ন কায়দায়। উদ্দেশ্য, সঙ্কট দেখা দিলেই উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি করবে। কিন্তু তাদের জন্যও রয়েছে কঠিন দুঃসংবাদ। এমন অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কঠোর অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছে র্যাব, পুলিশ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর লালমাটিয়ার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে লুকিয়ে রাখা ৫১২ লিটার সয়াবিন তেলসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক কর্মকর্তা লায়েকুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।
এলিটফোর্স র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সয়াবিন তেলসহ এমন কিছু ভোগ্যপণ্যের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কঠোর অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। র্যাব সদর দফতরসহ সব ব্যাটালিয়নকে এ ব্যাপারে নিজ নিজ এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে তালিকা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা জড়িত ব্যক্তি বা চক্রকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলছে। যেখানেই সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে সেখানেই কঠোর অভিযান চালানো হবে। তবে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকার যেখানে বাজার পরিস্থিতি সহনীয় ও স্বাভাবিক রাখতে নানা পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে পাল্লা দিয়ে বাজার পরিস্থিতি অস্থির করতে ব্যাপক সক্রিয় অধিক মুনাফালোভী একাধিক চক্র। সরকার গত বৃহস্পতিবার সয়াবিন তেলের ওপর আরওপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়, যাতে বাজারমূল্য কমে আসে এবং সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তিতে কেনাকাটা করতে পারে। কিন্তু ‘চোরে না শোনে ধর্মের বাণী’ এমনই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দেশের বাজার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছে। কেবল যে ব্যবসায়ীরাই এমনটি করছে তাও নয়, একশ্রেণির লোভী মানুষও নেমেছে অবৈধ মজুদের মৌসুমি ব্যবসায়। এদের অন্যতম একজন হলেন গ্রেফতারকৃত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক কর্মকর্তা লায়েকুজ্জামান। যিনি অবসরে যাওয়ার আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ফরিদপুরে উপসহকারী পরিচালক পদে চাকরি করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানিতে।
শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আসন্ন রমজানে বাড়তি লাভের আশায় লায়েকুজ্জামান এ অপকর্ম করেন। শুক্রবার রাতে ঢাকার লালমাটিয়ার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৫১২ লিটার সয়াবিন তেলসহ লায়েকুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জানান, লালমাটিয়ার একটি ফ্ল্যাটে বাস করতেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা লায়েকুজ্জামান। পাশেই অবস্থিত শ্বশুরের বাসাটিও তিনি দেখাশোনা করতেন। তিনি ৫১২ লিটার তেল শ্বশুরের বাসাতেই মজুদ করে রেখেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জমান সময়ের আলোকে বলেন, অবৈধ মজুদদারি অবশ্যই বেআইনি কাজ। অবৈধভাবে বা কৃত্রিম উপায়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সবসময়ই এ ধরনের বিষয়ে পুলিশ কাজ করে থাকে। এ ধরনের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ভূমিকা পালন করে আসছে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ মার্চ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ড উপজেলার রামনগর বাজারে অভিযান চালিয়ে দুই ব্যবসায়ীর দোকান থেকে ৫ হাজার ১০০ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার ও ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানান, গোপন সূত্রের খবরে রামনগর বাজারের ব্যবসায়ী দিলদার আলীর মুরগির খামার থেকে ১৩টি ড্রামভর্তি ২ হাজার ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল ও বিধান সাহার গুদাম থেকে ১২টি ড্রামভর্তি আড়াই হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। এ সময় অবৈধভাবে তেল মজুদ করার দায়ে দিলদার আলীকে ৫০ হাজার ও বিধান সাহাকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তারা অধিক মুনাফার লোভে উচ্চমূল্যে বিক্রির আশায় গত মাসেই এসব তেল অবৈধভাবে মজুদ করেছিলেন। একই দিনে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির অভিযোগে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ‘গোপন গুদামে’ অভিযান চালিয়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর আগে ৭ মার্চ কুমিল্লায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সয়াবিন তেল মজুদ রেখে বেশি দামে বিক্রি করায় দুই দোকানি ও এক ডিলারকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। মজুদ রেখে বেশি দামে বিক্রি করায় কুমিল্লা নগরীর পুলিশ লাইন ও স্টেশন রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫০০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে গোডাউন সিলগালা করা হয়েছে। তার আগে ৬ মার্চ ফেনীতে সরকারি অনুমোদনবিহীন ৮ হাজার ৫৬৮ লিটার অবৈধ সয়াবিন তেলসহ একটি কাভার্ড ভ্যান জব্দ করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় কাভার্ড ভ্যানের চালক ও সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়। কাভার্ড ভ্যান তল্লাশি করে ৬০৪টি কার্টনে ওই পরিমাণ সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। সয়াবিন তেল পরিবহনের কোনো বৈধ কোনো কাগজপত্র চালক দেখাতে পারেনি। এসব সয়াবিনের বিএসটিআইয়ের কোনো অনুমোদনও ছিল না। পুলিশ জানায়, কাভার্ড ভ্যানটি চট্টগ্রাম থেকে ফেনীর বিসিক শিল্পনগরীর পাশ দিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। ভোজ্য তেল সয়াবিনের অতিরিক্ত দাম রাখায় গত ৫ মার্চ জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি ডিলারের দোকান সিলগালা করে। এ সময় আবুল খায়ের ট্রেডার্স নামে ওই ডিলারের কাছে থাকা ৬০ ব্যারেল তেল জব্দ এবং আরও ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ১ মার্চ ভোলায় একটি কাভার্ড ভ্যান থেকে ৩২ ব্যারেল চোরাই সয়াবিন তেল জব্দ করে কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের সদস্যরা। ওইদিন সকালে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ফেরিঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে এগুলো জব্দ করা হয়। এ সময় ফরহাদ হোসেন (২৩) নামে কাভার্ড ভ্যান চালককে আটক করা হয়। এর আগে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল রংপুর নগরীর মধ্য পার্বতীপুর এলাকার হানিফ মিয়ার বাড়ির বক্স খাটের নিচ থেকে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের ১ হাজার ২৩৮ লিটার ভোজ্য তেল উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই সময় লাল মিয়া ও হানিফ নামে দুজনকে আটকও করা হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে সারা দেশেই অভিযান চলছে। সয়াবিন তেল ছাড়াও আমরা সার্বিক নিত্যপণ্যের বাজার মনিটরিং করছি। যেখানেই অসঙ্গতি পাচ্ছি সেখানেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সাধারণত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর একসঙ্গে মিলেই দফায় দফায় অভিযান চালানো হচ্ছে। আমাদের অভিযানের সময় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সহযোগিতা করছে। আমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে মাঠে কাজ করছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক মাস ধরেই বাজারে সবজি থেকে শুরু করে অধিকাংশ কাঁচা তরকারির মূল্য চড়া বা অস্বাভাবিক বেশি। এ ছাড়া তেল ও চালের বাজারও টালমাটাল। তার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী চক্র কতিপয় পণ্যের বাজার মূল্য নিয়ে ‘ছিনিমিনি’ খেলা শুরু করেছে। এরই মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের মূল্য খুচরা পর্যায়ে ১৪৩ টাকা বেঁধে দিয়েছে সরকার। অথচ পাইকারি ব্যবসীয়রাই বিক্রি করছে ১৭৬ টাকায়, খুচরায় সেটি হয়ে যাচ্ছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা।