পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস ।

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস ।

বেশ কিছুদিন ধরেই বেসামাল ভোজ্যতেলের বাজার দর নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। দিন যাচ্ছে। দাম বাড়ছে এই নিত্যপণ্যের। কেন বাড়ছে? এর সঠিক ব্যাখ্যা বিগত দিনেও মেলেনি।

খুচরা ব্যবসায়ীরা গত ১৫ অক্টোবরের পর থেকে লিটারপ্রতি সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা। এবার যদি হিসাব মেলানো যায় তাহলে গত দেড় বছরে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ! বছর দেড়েক আগেও লিটারপ্রতি সয়াবিনের খুচরা মূল্য ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে।

এভাবেই একের পর এক বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এ ছাড়া আরো কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে যেগুলোর ব্যবহার কম হয়। তবে সেগুলো নিয়ে আলোচনাও কম। অথচ সবার আগোচরে এসব পণ্য মানুষের পকেট কেটে বাড়তি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ভোক্তাদের ত্রাহি অবস্থা। যেখানেই হাত দেয়া যায় সেখানেই দামের বাড়তি উত্তাপ।

সম্প্রতি পণ্যের চড়া মূল্যের প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে মাঠে কর্মসূচি পালনসহ বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। তাতে লাভ কী? দুর্বলের কথা তো কারো শোনার কথা নয়। দুর্বল আর অসহায় মানুষগুলো সবার অধিকার নিশ্চিত করতে পৃথিবীজুড়ে সংগ্রাম করে। কখনও তাদের সংগ্রাম সফল হয়, বেশিরভাগ থাকে ব্যর্থ হওয়ার তালিকায়। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের দাবি যদি যৌক্তিক মনে না করে তাহলে দিনের পর দিন রাজপথে চিৎকার করেও কোনো লাভ হয় না।

দেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, একদিকে কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অনেক মানুষ বেকার। অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। অনেক মানুষ সঞ্চয় ভেঙে টিকে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ভীত অনেকটা মজবুত বলেই অর্থনীতির চাকা এখনও স্বাভাবিক। তবে সাধারণ মানুষ পণ্যের বাড়তি দামে একেবারেই দিশেহারা, তা বাজারে না গেলে অনুভব করা কঠিন।

এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের বাড়তি দাম নির্ধারণে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছে। এটা স্বভাবিক। যখন দেশে পণ্যের দাম কমার নজির কম, সেখানে সরকার যদি কোনো পণ্য নিজ উদ্যোগে বাড়িয়ে দেয় তবে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা কে দেখবে? এর মধ্যে কাঁচামরিচের কেজি শতের ঘর অতিক্রম করেছে। পিঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে ৮০টাকা। শাক সবজিও বেশ চড়া। সবচেয়ে বেশি চড়া টমেটোর বাজার। প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৬০টাকায়। এভাবে আলাদা করে যদি পণ্য ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে সব কিছুর দামই বাড়তির দিকে।

এবার আসা যাক চিনির দিকে। চিনি শিল্প করপোরেশনের উৎপাদিত লাল চিনি এখন বাজারে ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। চিনি শিল্প করপোরেশনের আরেকটি পণ্য হলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যা করপোরেশনের কোনো শো-রুম থেকে কেনা সম্ভব নয়। মতিঝিলে প্রতিষ্ঠানের কাউন্টারে গেলেই বলা হয়, স্যানিটাইজার নেই। অথচ ফুটপাতে অভাব নেই। বাড়তি দামে সরকারি এই পণ্যটি দেদার বিক্রি হচ্ছে। অথচ দেখার কেউ নেই। কোভিডের কারণে চিনি শিল্প করপোরেশন কর্তৃপক্ষ স্যানিটাইজার উৎপাদন শুরু করেছে। মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও বেশি। কিন্তু বাজারে সরবরাহের পরিমাণ নেই বললেই চলে। যা আছে তা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। সময়ের কারণে এখন স্যানিটাইজার নিয়েও বাণিজ্য দেখতে হচ্ছে।

অনেকের হয়ত মনে থাকার কথা- গত পাঁচ বছর আগে পেন্সিল ব্যাটারির দাম কত ছিল? এখন কিন্তু একটি পেন্সিল ব্যাটারি কিনতে লাগে ১৫ টাকা। বাসন ধোঁয়ার জন্য একটি ছোট ভিম সামান দেড় মাসের ব্যবধানে পাঁচ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা। বেড়েছে লাক্স সাবানের দামও। এমনকি সব ধরনের কাপড় কাঁচার সাবানের দামও বাড়তি। মুসুরের ডাল, মুড়ি, রসুন, আদার দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের মনমতো।

আলু নিয়ে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের একটি খবর বলছিলেন একজন। ঢাকার এই বাসিন্দার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা। গল্পের ছলে তিনি বললেন, গ্রামের বাজারে ছোট গোল সাদা আলুর কেজি ২৫ টাকা। পাইকারী কিনলে ২০ টাকা। ঢাকায় এই আলু প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০টাকা। যাদের প্রয়োজন ৪০ টাকা কেজিতেই কিনছেন। প্রশ্ন হলো বাজার বা জেলা ভেদে প্রতি কেজি আলুতে এত ব্যবধান কেন? তাছাড়া নেত্রকোণায় তো এই আলু উৎপাদন হয় না। ঢাকায় যেসব অঞ্চল থেকে আমদানি করা হয় সেখানেও একই অঞ্চল থেকে আসে।

এদিকে ধানের ভালো ফলনের মধ্যেও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। চড়া ডিমের বাজারও। মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সবখানেই হতাশার খবর। বাজারে গিয়ে এমন একজন ক্রেতা পাওয়া যাবে না তিনি হাসিমুখে ফিরছেন। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনকে এখন খুব হিসাব করেই চলতে হয়। অনেক ব্যবসায়ী বলেন, বাড়তি দামের কারণে অনেকে এখন কম পণ্য কিনছেন। আগে যারা এক কেজির কম সবজি নিতেন না, এখন অর্ধেক নিচ্ছেন।

একদিকে কোভিড পরিস্থিতির ধাক্কা অন্যদিকে পণ্যর দাম লাগামছাড়া। তাহলে বেকার মানুষগুলোর কথা কি কারো ভাবনার মধ্যে নেই? যদি জনসংখ্যা ১৬ কোটি হয় তাহলে প্রায় তিনভাগ মানুষ ক্ষতির মধ্যে। এই ভাবনাটুকু সরকারের নিশ্চয়ই ভাবা উচিত। মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র, আইন বা পরিচালন-নীতি। যেখানে সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকে সেখানে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে সরকার চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। যা হচ্ছে তা এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকার যদি সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন সেক্টরের পরিধি বাড়িয়ে প্রণোদনা দিতে পারে তাহলে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশিল রাখতে প্রয়োজনে কেন প্রণোদনা নিশ্চিত করতে পারে না। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম উৎস হলো গার্মেন্টস সেক্টর। এই সেক্টরে কোটির বেশি মানুষ যুক্ত। অল্প আয়ের এই মানুষগুলো যদি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারে তাহলে জাতীয়ভাবে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বেকারত্ব আর পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যাতাকলে একটি পুষ্টিহীন আগামী প্রজন্ম তৈরী হোক এটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য হতে পারে না।

সেইসঙ্গে প্রতি বছর বাড়তি বাসা ভাড়ার যাতাকল তো আছেই। যুগের পর যুগ কেটে গেলেও বাসা ভাড়া নির্ধারণ করা সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব হয়নি। যেমন সম্ভব হয়নি ঢাকা মহানগরীর যানবাহনের ভাড়া নিয়ন্ত্রণ। অনেকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বাসা ভাড়া নির্ধারণ না করাই ভালো। তাদের যুক্তি হলো, বাসা ভাড়া নির্ধারণ করে দিলে মালিকপক্ষই লাভবান হবে। এসব কথার মানে হলো, সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বা আস্থার সংকট। দিন দিন নানাভাবে মানুষ বঞ্চিত হতে হতে এরকম মানসিকতা তৈরী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সরকার ইচ্ছা করলেই এসব সমস্যা সমাধান করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে। সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। সবার আগে জরুরি হলো সাধারণ মানুষ যা বলছে তা সত্য কিনা বুঝতে চেষ্টা করা। সরকারকেই জনগণের মনের ভাষা পড়তে জানতে হবে। যদি সত্য হয় অবশ্যই জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাজারে সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে। সরকারের পক্ষে একটু নজর দিলেই বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশিল করা সম্ভব।

অর্থ বাণিজ্য