সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতি

সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতি

সোনার হরিণ সরকারি চাকরির একেবারে কাছাকাছি হিমেল (ছদ্মনাম)। তাও আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে! লিখিত পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হয়েছে। ভাইভাও হয়েছে মনমতো। সবাই বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরিতে অনিয়ম হয় না।

তাহলে হিমেলের চাকরি ঠেকায় কে? এখন শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাকি। খুশিতে আত্মহারা হিমেলের দিনমজুর বাবা। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসিটিভি অপারেটর পদে পরীক্ষায় যখন ভাইভার জন্য মনোনীত হয়েছিল তখন থেকেই স্বপ্ন বোনা শুরু।

এবার ছেলেকে একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেয়ার পালা। কিন্তু হঠাৎ স্বপ্ন ভঙ্গ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারে। বলা নেই কওয়া নেই একই পদে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। হিমেলকে অবশ্য পুনরায় আবেদন ছাড়াই পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দু’জন পরীক্ষার্থী জালিয়াতি করেছেন। তাদের পরিবর্তে পরীক্ষা দিয়েছে অন্য কেউ। তাদের সহায়তা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দু’জন যুগ্ম পরিচালক। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তদন্তে ধরা পড়ায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের।

একই সাথে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু অন্যের অপরাধের দায় নিতে রাজি নন হিমেল ও তার সাথে কৃতকার্য অন্যরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন চাকরিপ্রার্থীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া পুনঃসার্কুলার স্থগিত করে কৃতকার্যদের কেন নিয়োগ দেয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিষয়টি এখন ঝুলছে আদালতে। হিমেলের বাবা-মায়ের স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে। চাকরি তো হয়ই নি বরং ঘাড়ে চেপেছে মামলার খরচের বোঝা। একটি সুপারশপে কাজ করে জোগাড় হচ্ছে আইনি লড়াইয়ের অর্থ। এত বড় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা কঠিন জেনেও বাবা-মায়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ক্ষীণ আশায় লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন হিমেল।

আমার সংবাদকে হিমেল বলেন, ‘শুধু মেধা থাকলেই চাকরি হয় না, ভাগ্যও লাগে। পদ কম কিন্তু মেধাবী প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক। মেধার সাথে ভাগ্যের সমন্বয় হলেই কেবল চাকরির পরীক্ষায় টেকা যায়। ভাগ্যটা ধরা দিয়েছিল কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে পরীক্ষায় ভালো করেও চাকরি হচ্ছে না। কেউ যদি অনিয়ম করে তার শাস্তি হবে। তাদের বাদ দেয়া হবে কিন্তু আমাদের কী দোষ? অনিয়মকারীরা চিহ্নিত হয়েছে। তাদেরকে যারা সহায়তা করেছে তারাও ধরা পড়েছে।

তাহলে আমাদের নিয়োগ না দিয়ে আবার সার্কুলার কেন? এখানে মূলত অনিয়মকারীদেরই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যারা ঘুষ নিয়েছে তাদের কেন্ডিডেট বাদ পড়েছে। তাই তারা নিয়োগ পরীক্ষা আটকে দিয়েছেন। পুনরায় সার্কুলার দিয়েছেন যাতে আবার বাণিজ্য করা যায়। আমরা এ অন্যায় সিদ্ধান্ত মানি না। তাই আদালতে গিয়েছি, আশাকরি ন্যায়বিচার পাব।’

দু’জন শিক্ষার্থীর অসদুপায় অবলম্বনের দায় বাকী সবাই কেন নেবে এ প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘নিয়োগের ক্ষেত্রে যাদের ভাইভায় ডাকা হয় তার অতিরিক্ত একটা পার্সেন্টেজ আমরা ভাইভা পর্যন্ত রাখি সেখানেও ব্যত্যয় হয়েছে। তাই নিয়োগ পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়েছে।’

মুখপাত্রের এমন বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ কারণেই বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, চাকরিপ্রার্থীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর পায়নি; তাই তারা কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।

তথ্য মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসিটিভি অপারেটর পদের ২৬টি ও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদের তিনটি শূন্যপদের জন্য ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০২০ সালের ২৭ মার্চ ওই পদের জন্য লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়, তবে করোনার কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়।

এরপর গত বছরের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল অ্যান্ড কলেজে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সিসিটিভি অপারেটর পদে ৭০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে অংশ নেন ১৪২ জন। উত্তীর্ণ হন ৩৪ জন। এছাড়া ও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদে ৫৭৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ১৯ জন। উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় গত বছরের ৬ জানুয়ারি।

মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের তথ্য যাচাইকালে আবুবকর সিদ্দিক নামে একজন পরীক্ষার্থীর হাতে লেখার গরমিল ধরা পড়ে। অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র ও নিজের হাতের লেখার মধ্যে মিল পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আবুবকর সিদ্দিক স্বীকার করেন, তার পক্ষে অন্য কেউ পরীক্ষা দিয়েছেন।

এরপর ১৩ জানুয়ারি বিশেষ তদন্তের নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, আবুবকর সিদ্দিকের পরিবর্তে নেত্তানন্দ পাল নামে একজন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষায় এমন অনিয়মের পরিকল্পনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ। আর আবুবকর সিদ্দিক ও আবদুল্লাহ আল মাবুদের সাথে নেত্তানন্দ পালের যোগাযোগ করিয়ে দেন অপর যুগ্ম পরিচালক মো. আলমাছ আলী। এ জন্য আলমাছ আলীর হিসাবে দুই লাখ টাকা জমা দেন আবুবকর সিদ্দিক।

আর আলমাছ আলী তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, সেই দুই লাখ টাকা লিখিত পরীক্ষায় অংশ দেয়া নেত্তানন্দ পালকে দেয়া হয়েছে। আর আবদুল্লাহ আল মাবুদ মৌখিক পরীক্ষার দিন আবুবকর সিদ্দিকের জন্য একাধিক কর্মকর্তার কাছে সুপারিশ করেন।

নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের সত্যতা পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ ও মো. আলমাছ আলীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৩ জুন দুই যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ ও মো. আলমাছ আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। কিন্তু ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও ওই দুই যুগ্ম পরিচালকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত ওই দুই কর্মকর্তার সাথে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রভাবশালী মহলের যোগাযোগ আছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। একই সাথে যেকোনো অজুুহাতে পাড় পাওয়ার জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন ওই দুই কর্মকর্তা। একই কারণে নিয়োগ পরীক্ষাটিও বাতিল করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, দুইজন দোষ স্বীকার করলেও অনিয়মে জড়িত সবাই চিহ্নিত হয়েছে। তাই তাদের নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। যেহেতু মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে তাই পুরো নিয়োগ পরীক্ষাটি বাতিল করে পুনরায় দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ চক্রটি অধিক সতর্কতার সাথে নিয়োগ বাণিজ্য চালাবে যাতে এবার আর ধরা না পড়ে। কৃতকার্যদের নিয়োগ না দিয়ে পুনরায় দরখাস্ত আহ্বান করার বিষয়টি অমানবিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময়ক্ষেপণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, যখন কাউকে সাসপেন্ড করা হয় তখন একটি কমিটি করা হয় এরপর আবার ফায়ার কমিটি করা হয় এবং তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়— এর একটি প্রসিডিউর আছে। তাড়াহুড়া করলে তারাও আবার কোর্টে যাবে।

এদিকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে (নং ৫২/২০২১) বিদ্যমান নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে পুনরায় দরখাস্ত আহ্বান করে। এতে আগের সিসিটিভি অপারেটর পদে ৭০০ জন ও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদে ৫৭৭ জনকে নতুন করে আবেদন ছাড়াই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এ সার্কুলারের ফলে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমান কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন এবং এতে আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করেন চাকরিপ্রার্থীরা।

তাই সংক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর একজন পরীক্ষার্থীর পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন। রিটের প্রেক্ষিতে পরদিন ১৫ সেপ্টেম্বর-২০২১ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ সংক্রান্ত ৫২ নং সার্কুলারটি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে আগে কৃতকার্যদের কেন নিয়োগ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারি করেন বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের আদালত। এর পর থেকে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন আছে।

প্রসঙ্গত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের চাকরির নিয়োগে জালিয়াতির পাশাপাশি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষাতেও জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসছে। সিসিটিভির অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনায় জালিয়াতচক্র হাতেনাতে ধরা পড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য পদের নিয়োগেও বিভিন্নভাবে জালিয়াতি হয়েছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা আছে। তবে কোনো তদন্ত না হওয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন।

সম্প্রতি সাধারণ অফিসার নিয়োগে অস্বাভাবিক ফল প্রকাশের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফল প্রকাশের পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেন চাকরিপ্রার্থীরা। এ সময় তারা প্রকাশিত ফলাফলকে অস্বাভাবিক দাবি করে তা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান। মানববন্ধন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর লিখিত আবেদন করেন তারা।

পরীক্ষার্থী তানজিদ হোসেন, পার্থ সরকার ও খায়রুল আমীন সাক্ষরিত ওই আবেদনে তারা বলেন, ‘যারা কৃতকার্য হয়েছে তাদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েও আমরা উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তাই আমরা ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি।’ এ কারণে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানানো হয়।

অপরাধ