ইউক্রেন ইস্যুতে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র্র ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে আবারও পাল্টাপাল্টি হুঙ্কার উচ্চারিত হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে রাশিয়া। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সাধারণ রাষ্ট্রের কাতারে নামিয়ে আনার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনে হামলা চলছেই। রাজধানী কিয়েভসহ কয়েকটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তথ্য দিয়েছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা গতকাল ২২তম দিনে পেরিয়েছে। রাশিয়ার এই সামরিক অভিযানে আবাসিক ভবনের মতো বেসামরিক স্থাপনায় হামলার অভিযোগ করে আসছে কিয়েভ। তবে এ ধরনের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে মস্কো। ইউক্রেনের জরুরি সেবা বিভাগ জানায়, কিয়েভের দারনিৎস্কি জেলায় স্থানীয় সময় গতকাল ভোর ৫টার দিকে ওই আবাসিক টাওয়ারে ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ আছড়ে পড়ে। পরে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও উদ্ধারকর্মীদের পাঠানো হয়। ভবনটির ১১তম ও ওপরের তলা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেয়াল ও মেঝে কেটে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এক ফেসবুক পোস্টে জেনারেল স্টাফ অব ইউক্রেন আর্মড ফোর্সেস দাবি করেছে, স্থল অভিযানে ব্যর্থ হয়ে রাশিয়া এখন বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। তারা বলছে, স্থল অভিযানে রাশিয়ার ব্যর্থতা মানে তারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরের অবকাঠামো এবং জনবহুল এলাকাকে লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জোর দিচ্ছে। জেনারেল স্টাফ অব ইউক্রেন আর্মড ফোর্সেস আরও দাবি করেছে, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সত্ত্বেও তারা আকাশ ও স্থল উভয় যুদ্ধেই জয়লাভ করছে। তারা শত্রুর ১০টি ‘এয়ার টার্গেট’ ভূপাতিত করেছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, ইউক্রেনে গত তিন সপ্তাহের লড়াইয়ে ৭ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে। তবে এ সংখ্যার যথার্থতার বিষয়ে সতর্ক করে তারা বলেছে, সংবাদমাধ্যমের তথ্য, ইউক্রেন ও রাশিয়ার দেওয়া পরিসংখ্যান, স্যাটেলাইট চিত্র এবং রাশিয়ার সাঁজোয়া যান ও সেনাদের আক্রান্ত হওয়ার ভিডিও পর্যালোচনা করে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউক্রেন দাবি করে আসছে, চলমান যুদ্ধে সাড়ে ১৩ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছে। তবে রাশিয়া বলছে, এই সংখ্যা ৪৯৮। ইউক্রেনীয় বাহিনী এক ফেসবুকে বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী তিনটি রুশ এসইউ-৩০এম এবং একটি এসইউ-৩৪ বোমারু বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। আরেকটি বিধ্বস্ত বিমানের মডেল শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া একটি ড্রোনেও হামলা চালানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি : রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী বলে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে পুতিনের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেন বাইডেন। এ মন্তব্যের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ক্রেমলিন। বিবিসি বলেছে, হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাইডেন মন থেকেই পুতিনের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করেছেন। বাইডেনের এমন মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং ক্ষমার অযোগ্য বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে থাকা দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, রাশিয়াকে হাঁটু গেড়ে বসানোর চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ‘ঘৃণ্য’ রুশোফোবিয়া (রাশিয়াভীতি) উসকে দিচ্ছে। এটা কাজ করবে না। আমাদের সব উদ্ধত শত্রুকে সাধারণের স্তরে নামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাশিয়ার আছে- বলেছেন রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি সেক্রেটারি মেদভেদেভ।
যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ আইসিজের, প্রত্যাখ্যান রাশিয়ার : ইউক্রেনের করা মামলায় গত বুধবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাশিয়াকে অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেয় জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত। আইসিজের আদেশটি দেওয়া হয় ১৩-২ ভোটে। বিপক্ষে মত দিয়েছেন রাশিয়া ও চীনের বিচারক। আইসিজের বিচারকরা বলেন, রাশিয়াকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, মস্কোর নিয়ন্ত্রণাধীন বা সমর্থিত অন্যান্য বাহিনী যেন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালিয়ে না যায়।
যুদ্ধের জন্য ক্রেমলিন যে যুক্তি দিয়েছে, তার সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আদেশে উল্লেখ করে আইসিজে।
অর্থাৎ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের রুশভাষীদের বিরুদ্ধে দেশটির কর্তৃপক্ষ গণহত্যা সংঘটন করছে বলে যে যুক্তি দিয়ে রাশিয়া সামরিক অভিযানে গেছে, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ পায়নি আদালত। আইসিজের আদেশ মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ আদেশ বাস্তবায়নের সরাসরি কোনো উপায় আদালতের নেই। অতীতে খুব বিরল ক্ষেত্রে দেশগুলো আইসিজের আদেশ অমান্য করেছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এ নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে ক্রেমলিন। আদালতের এ নির্দেশের একদিন পর রাশিয়া এই প্রতিক্রিয়া জানাল। গতকাল ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, আমরা এই সিদ্ধান্ত আমলে নিতে পারব না। আইসিজের দেওয়া রায় কার্যকরের জন্য রাশিয়া ইউক্রেন দুই পক্ষকেই একমত হতে হবে। পেসকভ দাবি করেন, লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি টানতে কিয়েভের সঙ্গে আলোচনায় মস্কোর প্রতিনিধি দল প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধব্যবস্থা মোতায়েন করছে যুক্তরাজ্য : পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধব্যবস্থা ‘স্কাই সেভার’ মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য, সঙ্গে থাকবেন ১০০ সেনাও। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস এ তথ্য জানান বলে বিবিসি লাইভে জানানো হয়। বেন ওয়ালেস বলেন, পোল্যান্ডের আকাশসীমাকে ‘রুশ আগ্রাসন’ থেকে সুরক্ষিত রাখতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, সেভার ‘অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা’, যা শব্দের গতিতে ছুটন্ত অবস্থায় টেনিস বল আকৃতির লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাজ্য সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, এই প্রতিরোধব্যবস্থায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে ত্রিমাত্রিক নজরদারি রাডার, যুদ্ধ ব্যবস্থাপনা, ইন্টেলিজেন্স স্যুট ও একটি মিসাইল লঞ্চার। এটি ৯৯ কেজি ওজনের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম, যা ঘণ্টায় ২ হাজার ৩০০ মাইল গতিতে ছুটতে পারে। এটি মূলত পোল্যান্ডকে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা থেকে বাঁচতে সক্ষম করে তুলবে।
ইউক্রেনে হামলা চালাবে না চীন : ইউক্রেনে কখনই কোনো হামলা চালাবে না চীন বলে এমন দাবি করেছেন কিয়েভে চীনা রাষ্ট্রদূত ফ্যান জিয়ানরোং। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ইউক্রেনকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করব। আমরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করব। লিভিউয়ের আঞ্চলিক প্রশাসন প্রধান ম্যাকসিম কোজিটিকসির সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের জনগণের জন্য একটি বন্ধু দেশ চীন। একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে, আমি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বলতে পারি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীন একটি শুভশক্তি। ফ্যান জিয়ানরোং বলেন, চীনা দূতাবাস কিয়েভ থেকে লিভিউতে সরে এসেছে। একটি অস্থায়ী সময় এখানে থাকব আমরা। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চীনের জন্য ভালো না। চীন যদি এই সংঘাত সম্পর্কে আগে থেকেই জানত, তবে তা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে চীনের কাছে সহায়তা চেয়েছে রাশিয়া। যদিও এ দাবি মস্কো ও বেইজিং অস্বীকার করেছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘আগ্রহী নয়’ হোয়াইট হাউস : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা নেতাদের ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন ইউক্রেনের আকাশকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করতে। কিন্তু তার এই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না পশ্চিমারা। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দেওয়া বক্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আবারও নো ফ্লাই জোন ঘোষণার দাবি জানান জেলেনস্কি। যদিও বাইডেন আগেও জানিয়েছেন নো ফ্লাই জোন ঘোষণার অর্থ চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের সীমা বাড়িয়ে তোলা। যা শেষমেশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে বিশ্বকে। গতকাল জেলেনস্কির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে হোয়াইট হাউস বলেছে, তারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘আগ্রহী নয়’। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, আমরা আগেও বলেছি, নো ফ্লাই জোন বাস্তবায়নের প্রয়োজন হবে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে রুশ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করতে হবে। ন্যাটোকে রুশ বিমানকে গুলি করে নিচে নামাতে হবে। আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে যেতে আগ্রহী নই। জেন সাকি বলেন, জেলেনস্কির বক্তব্য দেখেছেন বাইডেন এবং তিনি ওই বক্তব্যকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক এবং শক্তিশালী’ মনে করেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণের ভিতর থেকে সিদ্ধান্ত নেন।