ভূমি মন্ত্রণালয় ঘিরে ভুয়া নিয়োগচক্র

ভূমি মন্ত্রণালয় ঘিরে ভুয়া নিয়োগচক্র

বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার ঘটবিলা গ্রামের আ. হান্নান মোল্লাহর ছেলে আ. রহিম। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ে ‘অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর’ পদে একটি ‘চাকরি’ পান এ তরুণ। কিন্তু এ নিয়োগের বিষয়ে কিছুই জানে না ভূমি মন্ত্রণালয়। কারণ রহিমের নিয়োগপত্রটি সম্পূর্ণ ভুয়া; মন্ত্রণালয় এই পদের জন্য বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশ করেনি এবং কাউকে নিয়োগপত্রও দেয়নি। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-১) সঞ্জীব কুমার দেবনাথ স্বাক্ষরিত ভুয়া নিয়োগপত্রে আ. রহিমকে আগামী ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সচিবালয় ‘ঢাকা কার্যালয়ে’ যোগদান করতে বলা হয়েছে। অথচ ক্যানসার চিকিৎসায় উপসচিব সঞ্জীব কুমার দেবনাথ এক মাসের বেশি সময় ধরে ভারতে রয়েছেন।

কে বা কারা নিয়োগপত্র দিয়েছেন, তা বারবার জানতে চাইলেও আ. রহিম কারও নাম বলেননি। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভাই আপনি আমাকে ভুয়া নিয়োগের বিষয়ে জানিয়েছেন, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি কাউকে আসলে চিনি না। আমার বোনজামাই চিনে।’ বোনজামাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও

রহিম এ প্রতিবেদককে সহযোগিতা করেননি। পরে রহিমের ফোন থেকেই অন্য একজন এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে এ প্রতিবেদককে গালাগাল করতে থাকেন। কারা রহিমকে নিয়োগপত্রটি দিয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের চিনি না।’ একপর্যায়ে তিনি ফোন কেটে দেন।

এর আগে আরও একাধিকবার রহিমের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথোপকথন হয়। তখন নিয়োগে টাকা-পয়সা লেগেছে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই চাকরিবাকরি পেতে তো টাকা লাগেই।’ কত টাকা লেগেছে জানতে চাইলে তিনি আর মন্তব্য করতে রাজি হননি। তার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা কবে হয়েছিল, তাও জানাননি রহিম।

মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার তোতা মিয়ার ছেলে মো. রাসেল মিয়া। তিনিও ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল ভূমি মন্ত্রণালয়ে ‘অফিস সহায়ক’ পদে একটি ভুয়া নিয়োগপত্র পান।

কর্মকর্তারা জানান, কয়েক বছর ধরেই ভূমি মন্ত্রণালয়ের নকল সিল ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে একটি প্রতারকচক্র ভুয়া নিয়োগবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রকে খুঁজে বের করতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে একাধিকবার চিঠিও দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু পুরো চক্রের সন্ধান মেলেনি। এর পর মন্ত্রণালয়ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে ভুয়া নিয়োগের নামে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক চাকরিপ্রার্থী। প্রতারিত হওয়া কয়েক তরুণের ভুয়া নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছে দৈনিক আমাদের সময়।

এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও সম্প্রতি তিনজনকে ভুয়া নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৯ ও ২০২০ সালেও ভূমি মন্ত্রণালয়ে ভুয়া নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। প্রতারকচক্র তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীদেরই বেশি নিশানা করে। বিশেষ করে ‘অফিস সহায়ক’ ও ‘অফিস সহায়ক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর’ পদেই ‘নিয়োগ’ দেয় তারা। মন্ত্রণালয়ের সিল ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে তৈরি হয় নিয়োগপত্র। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা খুব বেশি লেখাপড়া জানেন না। ফলে জালিয়াতির বিষয়ে তাদের ধারণাও কম। এ জন্য তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা সহজ। বিপদে পড়ার ভয়ে ভুক্তভোগীরাও প্রতারকদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে না। ফলে প্রতারকরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলেন, আ. রহিমের মতো প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করলে জানা যাবে, কারা তাদের নিয়োগপত্র দিয়েছে। আর মন্ত্রণালয়ের কোনো যোগসূত্র ছাড়া এমন প্রতারণা সম্ভব নয়। সুতরাং এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আব্বাস উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো নিয়োগই আমরা দিইনি। এটি সম্পূর্ণ ভুয়া। আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করব। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কাছে চিঠি লিখব। কারা এই ভুয়া নিয়োগের সঙ্গে জড়িত তা বের করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে এ রকম কয়েক প্রার্থীকে ভুয়া নিয়োগ দিয়েছিল একটি চক্র। আমরা ওই ভুয়া নিয়োগের যোগদানপত্রগুলো যাছাই করে আইনিব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।’

২০১৯ ও ২০২০ সালে দুই ভুয়া নিয়োগ

কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মো. রাসেল মিয়াকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে ‘অফিস সহায়ক’ অস্থায়ী পদে যোগদানপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই ভুয়া নিয়োগপত্র যাচাই-বাছাই করতে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। উপসচিব মোসা. নাজমুন নাহারের স্বাক্ষরে চিঠিটি দেওয়া হয় ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর। কিন্তু পুলিশ তা যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে কিনা তা জানাতে পারেননি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০২০ সালের কোনো স্মারক আমাদের কাছে পেন্ডিং নেই। আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি।’ প্রতারকচক্রের বিষয়ে কী জানা গেল, সে বিষয়ে তিনি সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।

জানা গেছে, রাসেল মিয়া চাকরিতে যোগদান করতে না পারায় তার বাবা তোতা মিয়া যোগদানপত্র সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মানিকগঞ্জের সিআইডি, পুলিশ পরিদর্শক (নি.) মোহা. আনারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা ভুয়া নিয়োগের সঙ্গে জড়িত দুজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তারা মানিকগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা। আদালতে তাদের নামে চার্জশিট দিয়েছি।’ কিন্তু অভিযুক্ত দুজনের নাম জানাতে পারেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।

২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের মো. রফিকুল ইসলামকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে ‘অফিস সহায়ক’ পদে একটি ভুয়া নিয়োগপত্র দেয় প্রতারকচক্র। রফিকুলের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৮ লাখ টাকা। নিয়োগপত্রে সিনিয়র সচিব মো. জিল্লুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জিল্লুর রহমান নামে কোনো সিনিয়র সচিব ছিলেন না। ওই সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী।

ওই জালিয়াতির ঘটনায় চারজনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা হয়। মামলার আসামিরা হলেন- আ. জলিলের ছেলে নয়ন মিয়া বাবু, ছায়দার রহমানের ছেলে বেলাল শিয়া, মৃত করম আলীর ছেলে আ. জলিল ও খবির উদ্দিনের ছেলে মো. ছায়দার। সবাই গাইবান্ধা সদরের কচুয়ার খামার গ্রামের বাসিন্দা। এদের মধ্যে নয়ন মিয়া ও মো. বেলাল শিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আব্দুল আজিজ। এ দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে বলেও জানান আজিজ।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাকছুদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় ঘিরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছে। আমরা এই প্রতারকচক্রের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। তবু প্রতারকরা থেমে নেই।’ চাকরিপ্রার্থীদের এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সাবেক এ সিনিয়র সচিব।

ভুয়া ওয়েবসাইটেও নিয়োগ

২০২০ সালে জাতীয় তথ্য বাতায়নের (পোর্টাল) ওয়েবসাইটের আদলে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থার ভুয়া নিয়োগপত্র ইস্যু করে প্রতারণার চেষ্টা করে একটি চক্র। ভূমি প্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (এলএটিসি) ইলেকট্রিশিয়ান রুহুল আমিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান, কে বা কারা তাকে ফোন করে জানায়, তিনিসহ তিনজনের নামে (িি.িষধঃপমড়ানফ.পড়স) ওয়েবসাইটে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়েছে। এর পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুয়া ওয়েবসাইট (িি.িষধঃপমড়ানফ.পড়স) তৈরি করে রুহুল আমিনসহ আরও তিন কথিত ব্যক্তি মো. রায়হান রহমান, মো. আবদুস সালাম ও মো. আরিফুল ইসলামের নামে ২০২০ সালের ২১ জুন ভুয়া নিয়োগপত্র ইস্যু করে প্রতারকচক্র। ওই বিষয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে এলএটিসি থেকে রায়হান রহমান, আবদুস সালাম ও আরিফুল ইসলামের নামে কোনো নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়নি। ওই নিয়োগপত্র ভুয়া। ভুয়া সরকারি ওয়েবসাইট তৈরি, স্বাক্ষর জাল ও ভুয়া নিয়োগপত্র প্রদান করা গুরুতর ও দ-নীয় ফৌজদারি অপরাধ। ভুয়া ওয়েবসাইটের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

ভুয়া নিয়োগ জনপ্রশাসনেও

গত ১ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নামেও একটি ভুয়া নিয়োগের ঘটনা ঘটে। প্রতারকচক্র ‘অফিস সহায়ক’ পদে তিনজনকে জনপ্রশাসনের ‘কর্মচারী নিয়োগ শাখায়’ নিয়োগ দেওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছে তাদের ভুয়া ‘পরিপত্রে’। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘কর্মচারী নিয়োগ শাখা’ নামে কোনো শাখাই নেই। নিয়োগও কখনই ‘পরিপত্র’ দিয়ে হয় না। এ ছাড়া এক মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী অন্য মন্ত্রণালয় দেয় না। কিন্তু প্রতারকদের পরিপত্রে জনপ্রশাসন থেকে নিয়োগ দিয়ে তাদের শিল্প মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। ভুয়া নিয়োগে উপসচিব কাজী মো. সাইফুল ইসলামের নাম ও জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে জিডি করেন যুগ্মসচিব কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। প্রতারিত তিন চাকরিপ্রত্যাশীর নাম-ঠিকানা লেখা হয়েছে- ১. শিউলী আক্তার, বাবা তপন কুমার আশ্চার্য, জেলা ময়মনসিংহ; ২. দোলা ইয়াসমিন, বাবা কবির উদ্দিন, জেলা চুয়াডাঙ্গা এবং ৩. মো. আরাফাত আলী, বাবা মৃত রহমত সরকার, জেলা ঢাকা।

সচিবালয়ে সক্রিয় প্রতারকচক্র!

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সচিবালয়ে নিয়োগ প্রতারণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল দৈনিক আমাদের সময়। ‘বিকালে পিয়নই সচিব!’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অফিস সময় শেষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়ার পর সংঘবদ্ধ প্রতারকরা পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে তারা ‘সচিব-উপসচিব’ বনে যান। তারা সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব কিংবা উপসচিবের কক্ষে চেয়ারে বসেই চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেন। ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের মূল হোতা সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ফরাশ শাখায় (সকালে অফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধের দায়িত্বে নিয়োজিত) কর্মরত মো. শফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে ঘটনায় জড়িত অন্যতম প্রতারক সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (অস্থায়ী) কেএম মোর্তুজা আলী রনি এখনো অধরা রয়েছেন।

অপরাধ