সাংসদে নাখোশ তৃণমূলে

সাংসদে নাখোশ তৃণমূলে

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা তৃণমূলের মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিতর্কিত, অজনপ্রিয় ও হাইব্রিডদের বাদ দিয়ে ত্যাগী, পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় নেতাদের দায়িত্বশীল পদে বসাবেন। মূলত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৃণমূল আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা।

তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন তৎপরতার মাঝেও থেমে নেই তৃণমূল আওয়ামী লীগের সংঘাত, সংঘর্ষ ও হামলা-পাল্টা হামলা। প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। আর এতে সরাসরি মদত দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় সাংসদ ও জেলা-উপজেলার প্রভাবশালী নেতারা। ফলে কাজে আসছে না কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসক্রিপশন। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলে দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও জেলা-উপজেলার শীর্ষ পদধারী নেতাদের বলয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দুর্দিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা।

প্রভাবশালী নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থাকা নেতাদের দাপটে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অনেক এমপি ত্যাগী নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের লোকজনকে দিয়ে মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি দিতে চেষ্টা করছেন। এছাড়া নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিলাসিতা, স্বজনপ্রীতির কারণে নিজ এলাকায় অধিকাংশ এমপির গ্রহণযোগ্যতা কমছে।

একইসঙ্গে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দল ক্ষমতায় থাকলেও বিনা কারণে মামলার আসামি হচ্ছেন অনেকেই। আর দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন হাইব্রিড ও দলছুট নেতাকর্মীরা।

সমপ্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় যেমন দলীয় নেতাকর্মীরা আহত-নিহত হচ্ছেন, তেমনি মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এতে একদিকে যেমন দলের জনপ্রিয়তা কমছে, অন্যদিকে অভিমানে দূরে সরে যাচ্ছেন ত্যাগী, পরিশ্রমী ও পরীক্ষিত নেতারা। তাই অভ্যন্তরীণ এসব দ্বন্দ্ব নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ চান তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। ওই সম্মেলনে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই দুপক্ষ মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসময় মঞ্চের ওপর চেয়ার ছুড়ে মারা, চেয়ার ভাঙচুর, কাঠের বাটাম, দেশি অস্ত্র, বাঁশের লাঠি ব্যবহার করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সম্মেলন স্থল ত্যাগ করেন।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই দুইভাগে বিভক্ত বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ। এদের এক পক্ষে নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অন্যপক্ষে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাছ আলী। তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই সম্মেলন স্থলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুগ্রুপের সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করা হচ্ছে। সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত করা হচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগে বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো জায়গা নেই।’

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের সান্দিয়ারা বাজার ও বশীগ্রাম ব্রিজ এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুপক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জানা যায়, দুই ভাগে বিভক্ত কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

এর একপক্ষে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, অন্যপক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান। স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি থাকায় মাঝেমধ্যেই এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ আমার সংবাদকে বলেন, ‘একটি অরাজনৈতিক বিষয়কে রাজনীতির মধ্যে টেনে আনা হয়। তখনই রাজনীতি কলুষিত হয়।’ যে ঘটনা ঘটেছে এটি রাজনৈতিক ইস্যু নয় বলে দাবি করেন তিনি। গত ১৩ মার্চ ইউনিয়নের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের দুপক্ষ। ঘটনাটি ঘটে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবি ইউনিয়নে।

জানা যায়, মৌডুবি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন বর্তমান চেয়ারম্যান রাসেল। ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াস মাহমুদ শিপন। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জেরেই সম্মেলন স্থলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তাদের কর্মী-সমর্থকরা। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ১০ কর্মী-সমর্থক আহত হন।

দীর্ঘদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে চলছে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। দীর্ঘদিনের কোন্দল ফের সামনে আসে গত ৭ মার্চ। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন সদর উপজেলার দুটি পক্ষ। দুগ্রুপের দুই দফা সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন আহত হন। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ সংঘর্ষের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করতেই ক্ষেপে যান নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল কুদ্দুস।

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় সাংবাদিকতা করেন, এ বিষয় নিয়ে চুপচাপ থাকেন। কোথায় ৭ তারিখ, কোথায় ২২ তারিখ। আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে কি হয়েছে। এটা নিয়ে কথা বলতে হবে।’

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় আওয়ামী লীগের দুগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আহত হন অন্তত ১০ জন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এদের একপক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন এবং অন্যপক্ষে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম রেণু।

এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম রেণু বলেন, ‘সোহরাব সাহেব পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার লোকজনকে নিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এনে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা করেছেন।’ যদিও এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সাবেক সাংসদ সোহরাব উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘ আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। মারামারি করার জন্য নয়। এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।’

রাজনীতি