জোটের শরিকদের চাপের মুখে রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনের আগে নয়, বিজয়ী হলেই জাতীয় সরকার গড়তে চায় দলটি। আর আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে। তবে জোটের শরিকরা চায়, দুই বছর মেয়াদি জাতীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। তবে দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত সমমনা শরিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবেন তারা।
সূত্র জানিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরেই দলের নীতিনির্ধারক নেতারা বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে কাজ করছেন। দলের নীতিনির্ধারক মহল এ বিষয়ে দলের সিনিয়র নেতা, জোট নেতা, সমমনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে এ কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে। গত সোমবার যুক্তরাজ্য বিএনপির আলোচনা সভায়ও নতুন ভাবনার ব্যাপারে আভাস দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল সমকালকে বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, জনগণ তার মৌলিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার নেই। সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি ছাড়া রাষ্ট্রকে মেরামত করা সম্ভব নয়।
জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যেসব দল ও ব্যক্তি শরিক হবে, তারা নির্বাচনে বিজয়ী হোক বা পরাজিত- বিএনপি তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার করতে চায়। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে চান তারা। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পরিবর্তন আনা হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে।
দলের সিনিয়র নেতাদের মতে, অতীতের মতো তিন মাসের মধ্যেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। এরশাদ সরকারের পতনের পরও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। পরে অন্যান্য নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার হলে আওয়ামী লীগ এতে লাভবান হবে। সরকারে তাদের অংশগ্রহণ থাকলে প্রশাসন নির্দলীয় করা কঠিন হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করা সহজ হবে না। দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার হলে গণতন্ত্র ব্যাহত হতে পারে।
বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় সরকার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন নেতারা। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে শরিক দলের নেতারা তাদের যুক্তিতে এখনও অনড় রয়েছে। আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। নেতারা আশা করছেন, বিএনপির যুক্তির সঙ্গে তারাও একমত হবেন।
সম্প্রতি আগামী নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সরকারবিরোধী জোটে স্পষ্ট দুটি মত দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে এক মঞ্চে আন্দোলন করলেও এখন ভিন্নমত প্রকাশ করছে জোটের শরিকরা। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক জেএসডি এবং ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক এলডিপি বলছে, জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। মাত্র তিন মাসে নির্দলীয় ব্যক্তিদের পক্ষে দলীয়করণে দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে মেরামত করে সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হবে না।
ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও দল দুটির সঙ্গে একই সুরে কথা বলছেন। আবার ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক নাগরিক ঐক্য জাতীয় সরকার এবং নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে আপত্তি তুলছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে। দলীয় সরকারের পক্ষে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। সমমনা দলগুলোর মধ্যে হঠাৎ কেন মতান্তর- এমন প্রশ্নের জবাবে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন বিরোধী শিবিরের শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লহ চৌধুরীর মত হচ্ছে, জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বচন। এতে আওয়ামী লীগ ভয় পাবে না। কেউ কারও পক্ষ নিয়ে ভোট চুরি করতে পারবে না। বিগত প্রায় ১৫ বছর সারাদেশে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। দেশ তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গেলেও যেভাবে প্রশাসন আওয়ামী লীগ ক্যাডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না।
নির্দলীয় সরকারের দাবির অবস্থান থেকে জাতীয় সরকারের দাবিতে স্থানান্তর হওয়ার বিষয়ে নানা যুক্তি দিচ্ছে দলগুলো। নেতারা মনে করেন, বর্তমানে রাষ্ট্রের যে দুরবস্থা, তাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে তা সমাধান করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকে সংস্কার করতে হবে। দলীয়করণের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। দেশের শাসনতন্ত্রে সংস্কার আনতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করতে হবে।
জাতীয় সরকারের পক্ষে এরই মধ্যে সমমনা গণফোরাম (মন্টু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার, গণঅধিকার পরিষদ প্রভৃতি দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে। জাতীয় সরকারের উদ্যোগকে সমর্থনকারী একজন নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় না থাকায় তারা সমমনা দলগুলোকে নিয়ে একই ইস্যুতে মাঠে নামছেন। বিএনপির সঙ্গেও আলোচনা চলছে।