সর্বনিন্ম দরদাতা না হলেও বিশেষ শর্তে ট্রেনের টিকিট বিক্রির কাজ পায়সহজ ডটকম

সর্বনিন্ম দরদাতা না হলেও বিশেষ শর্তে ট্রেনের টিকিট বিক্রির কাজ পায়সহজ ডটকম

নিজস্ব প্রতিবেদক : ট্রেনের টিকিট বিক্রি নিয়ে কয়েকদিন ধরে চলছে নানা ভোগান্তি। নতুন অপারেটর ‘সহজ লিমিটেড বাংলাদেশ’ দায়িত্ব নেয়ার চার দিন পেরুলেও দুর্ভোগ কাটেনি। যদিও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেয়া হয় দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে। সর্বনিন্ম দরদাতা না হলেও বিশেষ শর্তে ট্রেনের টিকিট বিক্রির কাজ পায় কোম্পানিটি। আবার চুক্তির শর্তানুসারে টিকিট বিক্রিতে ব্যর্থ হলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেলওয়ে।

যদিও পুরো বিষয়টি চেপে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। শুধু শোকজ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে রেলওয়ে। এমনকি রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, ট্রেনের বিক্রিতে নতুন অপারেটর নিয়োগে ২০১৯ সালের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ সময় পাঁচ বছরে ২০ কোটি টিকিট বিক্রিতে পুরনো অপারেটর সিএনএস (কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম) চেয়েছিল ২৪ কোটি টাকা। টিকিটপ্রতি কমিশন ছিল এক টাকা ১৮ পয়সা। আর সহজ, সিনেসিস ও ভিনসেন জয়েন্ট ভেঞ্চারের প্রস্তাব ছিল ৩০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রতি টিকিটে কমিশন এক টাকা ৩২ পয়সা। এ হিসাবে সর্বনিন্ম দরদাতা ছিল সিএনএস।

যদিও টিকিটের কমিশনের ক্ষেত্রে বিশেষ একটি শর্ত দেয় সহজ। তারা টিকিট বিক্রির কমিশনের মধ্যে ২৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা বিভিন্ন রেল স্টেশন ও ওয়েবসাইট থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ আয় করবে। বাকি পাঁচ কোটি টাকা রেলের কাছ থেকে নেবে। এতে প্রতি টিকিটে কমিশন পড়বে ২৫ পয়সা। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এ যুক্তিতে সহজকে সর্বনিন্ম দরদাতা নির্বাচিত করে। এর বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ করে সিএনএস।

শুনানি শেষে সিপিটিইউ রায়ে জানায়, বিজ্ঞাপনের টাকা সরকারের, তা সহজ নিতে পারবে না। আর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি টিকিটপ্রতি চার টাকা ৩৫ পয়সা চার্জ প্রাক্কলন করেছে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে। সিএনএসকে কাজটি দেয়ার রায় দেয়া হয়। তবে সিপিটিইউয়ের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে সহজ-এর পক্ষে রায় যায়। এর বিরুদ্ধ সিএনএস আর আপিল বিভাগে যায়নি। তাই সঙ্গে ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সিএনএসের সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে।

রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের বিষয়টি দরপত্রে ছিল না। তাই তাদের এ শর্তে কাজ দেয়া দরপত্রের লঙ্ঘন। তবে রেলওয়ের একাধিক বিদায়ী কর্মকর্তা সহজ ডটকমকে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে কাজটি দেয়ার সুপারিশ করেছিল। আর চুক্তি অনুযায়ী, অপারেটরের যেসব সক্ষমতার শর্ত ছিল, তা সহজ এখনও দেখাতে পারেনি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে রেলের সার্ভার ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে দরপত্রের শর্ত না মেনে।

এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি সইকৃত চুক্তির শর্তানুসারে, ২১ কার্যদিবস পর ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু করবে সহজ ডটকম। তাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিদিনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে চুক্তির ২১ কার্যদিবস পর পাঁচ দিন (২১-২৫ মার্চ) তারা টিকিট বিক্রি করতে পারেনি। এ সময় রেলওয়ে হাতে লিখে টিকিট বিক্রি করেছে। তবে অজ্ঞাত কারণে কোম্পানিটিকে এ পাঁচ দিনের জন্য কোনো জরিমানা করা হয়নি।

এদিকে চুক্তির অপর শর্তে বলা হয়েছে, ট্রেনের অনলাইন টিকিটিং, মোবাইল টিকিটিং ও কাউন্টার টিকিটিং ব্যবস্থা কোম্পানিটি ২৪ ঘণ্টা পরিচালনা করবে। চুক্তির ২১ কার্যদিবস পর এ কাজে ব্যর্থ হলে প্রতিবারের জন্য প্রতি ঘণ্টায় দুই হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে কোম্পানিটিকে। তবে ২৬ মার্চ থেকে টিকিট বিক্রি শুরুর পর ভোগান্তির শত শত অভিযোগ এলেও সহজ ডটকমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, টিকিট নিয়ে প্রতি মুহূর্তে অভিযোগ আসছে। তা ‘সহজ’কে জানানোও হচ্ছে। তারা রেলকে জানিয়েছে, ২২ লাখ মানুষ একসঙ্গে ওয়েবসাইটে আসায় ক্যাপাসিটিতে সমস্যা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সাল থেকে টানা ১৫ বছর ট্রেনের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে ছিল সিএনএস। অপারেটর বদলে পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় দেশের ৭৭টি স্টেশনে কম্পিউটারাইজড টিকিট বিক্রি শুরু হয়। তখন থেকেই দুর্ভোগ চলছে।

এদিকে ট্রেনের অনলাইন টিকিট বিক্রিতেও ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে সিএনএস নিজস্ব সার্ভার ও ওয়েবসাইট থেকে টিকিট বিক্রি করত। তবে বর্তমানে রেলওয়ের নতুন ওয়েবসাইট (http://www.eticket.railway.gov.bd) থেকে টিকিট বিক্রি করছে সহজ। সার্ভারও রেলের। এজন্য গ্রাহকদের নতুন করে নিবন্ধনও করতে হচ্ছে। কিন্তু দিনভর চেষ্টা করে অনেকে এ ওয়েসাইটে প্রবেশ করতে পারেনি। বাববার ‘দিস সাইট ক্যান নট রিচড’ বার্তা আসে। আর যারা ঢুকতে পেরেছেন, তারাও স্বস্তি পাননি।

টিকিট প্রত্যাশী শাফকাত আমিন বলেন, ‘ওটিপি আসছে না। প্রোফাইল এডিট করার সুযোগ নেই। ড্যাশবোর্ড ও ট্রেনের সময়সূচি দেখার সুযোগ নেই। আগের মতো কাউন্টার ও অনলাইন কোটায় অবিক্রীত টিকিট সংখ্যা দেখা যাচ্ছে না। সিট একবার সিলেক্ট করলে আর আনসিলেক্ট হয় না। টাকা পরিশোধের পদ্ধতিতে ‘বিকাশ’ কাজ করছে না। টাকা পরিশোধের পরও টিকিট আসছে না। টিকিটপ্রতি ২০ টাকা সার্ভিস হওয়ার কথা থাকলেও তা ২০ শতাংশ দেখাচ্ছে।’

এদিকে টিকিটে যাত্রার সময় ভুল থাকায় যাত্রীরা ট্রেন মিস করেছেন। এতে রেলওয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। স্টেশন টু স্টেশন ভাড়া ভুল হওয়ায় বিভিন্ন স্টেশনের শিফট ও ডেইলি রিপোর্টে পার্থক্য থাকায় রাজস্ব হারানোর আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এসব অভিযোগে টিকিট বিক্রির অপারেটর প্রতিষ্ঠান সহজ লিমিটেডের কাছে জবাব চেয়েছে বাংলাদেশে রেলওয়ে।

সহজ লিমিটেডের ব্যবস্থা পরিচালক মালিহা এম কাদিরকে দেয়া চিঠিতে রেলওয়ে যুগ্ম পরিচালকের (অপারেশন) দায়িত্বে থাকা এ এম সালাহউদ্দিন বলেন, গত ২৬ মার্চ অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। টিকিট ইস্যু বন্ধ হওয়া এবং পুনরায় চালুর বিষয়ে রেলওয়েকে তথ্য দেয়নি সহজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে রেলওয়ের টিকিটিং কার্যক্রমের বিষয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় রেল প্রশাসন এ বিষয়ে জবাব দিতে পারছে না। ফলে রেলওয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ বিষয়ে সহজ কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

যদিও চিঠির বিষয়ে মালিহা এম কাদিরের বক্তব্য জানা যায়নি। আর রেলপথমন্ত্রী, রেল সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিদেশে থাকায় তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৯৯৪ সালে কম্পিউটারভিত্তিক টিকিটিং সিস্টেম চালু করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ২৭টি স্টেশনে কম্পিউটারাইজড টিকিট বিক্রি শুরু হয়। পরে তা ৭৭টি স্টেশনে সম্প্রসারণ করা হয়। দৈনিক প্রায় ৯০ হাজার ও মাসিক প্রায় ২৭ লাখ যাত্রীর টিকিট কম্পিউটারের মাধ্যমে ইস্যু করা হয়। এসব টিকিটের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ টিকিট অনলাইন/মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দেয়া হয়। তবে অ্যাপ সিএনএস হস্তান্তর না করায় এ মাধ্যমে টিকিট বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে।

তথ্য প্রুযুক্তি