প্রতারণা ঠেকাতে দেশে আর মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হবে না। বরং যেসব কোম্পানি অনুমোদন না পেয়ে নামে-বেনামে ব্যবসা চালাচ্ছে সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে এবার এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি বাতিলের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ২০১৩ বাতিলের বিষয়ে গত ৩ মার্চ একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই সভায় অধ্যাদেশটি বাতিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়।
জানা গেছে, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ২০১৩ পাস করা হয়। আইন ভঙ্গকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল অথবা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়। কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের বিধানও রাখা হয়। অধ্যাদেশে ওই সময় চলমান কোম্পানিগুলোকে ৯০ দিনের মধ্যে সনদ নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বহুস্তর বিপণন বা মাল্টি লেভেল ব্যবসাকে শৃঙ্খলায় আনার জন্য ২০১৩ সালে যে অধ্যাদেশটি জারি হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ওই অধ্যাদেশ জারির পর কয়েকটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়ে দেখা গেছে, তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক ছিল না। ফলে লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী কোনো কোম্পানিকে পরবর্তীতে আর অনুমোদন দেওয়া হয়নি। উপরন্তু যুবক, ডেসটিনির পর সাম্প্রতিককালে ইভ্যালি, ইঅরেঞ্জের মতো ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর প্রতারণার কারণে সরকার এখন আর এমএলএম ব্যবসার বিষয়ে ভাবতে চায় না। সঙ্গত কারণেই অধ্যাদেশটি বাতিলের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আন্তমন্ত্রণালয় সভায় অধ্যাদেশ বাতিল ও বহাল রাখা দুই ধরনের সুপারিশই এসেছে। আমরা এ বিষয়ে আইনি মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাণিজ্য সচিব জানান, অধ্যাদেশটি বাতিল হলে চলমান মামলাগুলোর ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়ে তাও খতিয়ে দেখতে হবে। জানা গেছে, ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে যুবক নামে একটি কাম্পানির অবৈধ ব্যাংকিংসহ নানা প্রতারণার চিত্র। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এর ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের দাবির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। যুবক-এর বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চালাতে চালাতেই ডেসটিনি নামে আরও একটি এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ২০০০-২০১২ সাল পর্যন্ত এক যুগ ধরে ডেসটিনি-২০০০ গ্রুপ সারা দেশে বহুস্তর বিপণন ব্যবসা চালিয়ে যায়। এ সময় কোম্পানিটি মানুষের কাছ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করে। তবে সে সময় এ ধরনের ব্যবসার প্রতারণা ঠেকাতে কোনো আইন ছিল না দেশে। ২০১২ সালে ডেসটিনির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর এর প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়। অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের অক্টোবরে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অধ্যাদেশটি জারির পর গত ১১ বছরেও তারা এর কোনো কার্যকারিতা খুঁজে পাননি। বরং এটি জারির পরপরই যে চারটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল সেগুলোও সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেনি। ফলে পরবর্তীতে আর কোনো কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এরপর অধ্যাদেশটি কার্যকর করতে ২০১৯ সালে এর বিধিমালা সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে এমএলএম ব্যবসার প্রতি গ্রাহকের আস্থা আর আছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, নেপালসহ ৫২টি দেশে পিরামিড পদ্ধতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। এই পদ্ধতিটির মধ্যেই গ্রাহক প্রতারণার কৌশল লুকিয়ে আছে। ফলে সরকার বাংলাদেশেও এই ব্যবসাটির কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। সূত্র জানায়, প্রজ্ঞাপন জারির পর নতুন করে অনুমোদন পাওয়া যাবে- এই আশায় কিছু প্রতিষ্ঠান এমএলএম ব্যবসা শুরু করে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু করে অনেক কোম্পানি শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। কেউবা পুরনো লাইসেন্সের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে এমএলএম কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতারণার ধরন পাল্টে অনেকে আবার ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডিরেক্ট টেলিমার্কেটিং, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ‘এমএলএম কোম্পানি’ গড়ে তুলেছে। তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ২০১৮ সালেই এই অধ্যাদেশটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে অনুযায়ী এই আন্তমন্ত্রণালয় সভাটি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এমএলএম ব্যবসার আবেদন করে যারা লাইসেন্স পায়নি, তারা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে।