ব্যাংক এশিয়ার অর্থ লোপাটে চেয়ারম্যানের হাত

ব্যাংক এশিয়ার অর্থ লোপাটে চেয়ারম্যানের হাত

বর্তমানে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঋণখেলাপি। আর্থিক খাতের এই বিষফোড়া দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পরিচালকদের চাপে এই বিষফোড়া বড় হচ্ছে। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে ব্যাংক এশিয়ায়। এজন্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যানকে অবৈধ সুবিধা দেয়ার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে ঋণ দিয়ে ব্যাংক এশিয়াসহ ডজন খানেক ব্যাংক সেটি আদায় করতে পারছে না। তবে ব্যাংক এশিয়া থেকে দেয়া ঋণের পরোক্ষ সুবিধাভোগী ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিজেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের পরিচালক ব্যক্তিগত বা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না। যদিও কৌশলে নিজেরই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংক এশিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যান আ. রউফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর ওয়েস্টার্ন মেরিনের দুটি ঋণ কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্ট (এককালীন অর্থ) ছাড়াই তিন বছর মোরাটরিয়াম পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা হয়। কিন্তু কাজটি মোটেও নীতিসম্মত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখায় পরিদর্শনে এই অনিয়ম ধরা পড়ে। ঋণ দুটি মন্দমানে খেলাপি করার নির্দেশ দেয়ার পরও তা পালন করেনি ব্যাংক এশিয়া। খেলাপির খাতা থেকে বাদ রাখা হয় গ্রাহককে।

এরপর ২০১৯ সালে ৩ মার্চ শিপইয়ার্ড রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ৩০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণটি একই বছরের ৩ জুন মঞ্জুর করে ব্যাংক এশিয়ার পরিচালনা পর্ষদ। এখানেও লঙ্ঘন করা হয়েছে একাধিক নীতিমালা। কারণ নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সাড়ে সাত শতাংশ জমা দেয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু তা পরিপালন করা হয়নি। প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশেও সাড়ে সাত শতাংশ আদায়ের কোনো নির্দেশনা ছিল না। তাছাড়া অন্য ব্যাংকে পুনঃতফসীলকৃত ঋণ থাকলে তাদের অনাপত্তি নেয়ার শর্তটাও ভঙ্গ করেছে ব্যাংক। বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে সুবিধা দেয়ার জন্যই এই অপকৌশল নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য পরিদর্শন টিমের।

কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী একাধিকবারে ঋণটি ছাড় করার শর্ত থাকলেও এটি বিতরণ করা হয়েছে একসঙ্গে (৩০ কোটি টাকা)। একই দিনে স্থানান্তর করা হয়েছে অন্য হিসাবে (অ্যাকাউন্টে), যার মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়েছে অন্য ব্যাংকের ঋণ ও খেলাপির দায়। যেমন ব্যাংক এশিয়া থেকে নেয়া ঋণের অর্থ মঞ্জুর হওয়ার দিনই তিনটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২৪ কোটি টাকা ওয়েস্টার্ন ফিশারিজ শিপইয়ার্ডের অপর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে (হিসাব নং- ০০৪১১০১০০০০০১৬২৭)। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান, যার চেয়ারম্যান আ. রউফ চৌধুরি। তিনি ব্যাংক এশিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যানও।

অন্য এক পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংক হেড অফিস করপোরেট শাখায় দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা দিয়ে আগের ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে। আরও একটি পে-অর্ডার ইস্যু করে প্রথমে ব্যাংক এশিয়ার প্রিন্সিপাল অফিসে ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের হিসাবে, পরে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় একই প্রতিষ্ঠানের অপর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসায় প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর আট কোটি এবং ২০২১ সালের ৩০ জুন ১৫ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে ব্যাংটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি স্বীকার করে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের পর আমরা টাকাগুলো সমন্বয়ের জন্য সময় চেয়েছিলাম। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আমাদের সময় দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে অর্ধেক টাকা সমন্বয় হয়েছে। জুনের মধ্যে বাকি টাকা সমন্বয় হয়ে যাবে।’

সূত্র জানায়, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে দেয়া ৪৩৫ কোটি টাকা ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। এই ঋণ পুনঃতফসিলেও করা হয়েছে অনিয়ম। আগের খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে ৩০ কোটি টাকার নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। তাতেও মানা হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা। বিভিন্ন ডিমান্ড লোন, ওয়ার্ক অর্ডার, ফোর্সড লোন, ওভার ড্রাফট ও পুনঃতফসিলকৃত টার্ম লোনের সুদসহ দায়কে দুই ভাগে বিভক্ত করে আবার পুনঃতফসিল করে দুটি মেয়াদি ঋণ সৃষ্টি করা হয়। আগের খেলাপি ঋণ ও অন্য প্রতিষ্ঠানের দায় সমন্বয়ে ঋণ দুটি ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রসঙ্গত, মাঝারি ও ছোট জাহাজ নির্মাণ খাতে বাংলাদেশের বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানির সুযোগ রয়েছেÑএমন স্বপ্নই দেখিয়েছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এ ব্যবসার মূলধন জোগাতে দেশের ১৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়। যদিও বিনিয়োগ অনুযায়ী কার্যাদেশ না পাওয়া, নির্ধারিত সময়ে জাহাজ সরবরাহে ব্যর্থতা ও উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে এখন মৃতপ্রায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ থাকলেও নগদ অর্থের সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে কোম্পানিটির কার্যক্রম।

যদিও পুঁজিবাজার থেকে ২০১৪ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারপ্রতি ২৫ টাকা প্রিমিয়ামে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিটি জাহাজ নির্মাণ ও বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর উপলক্ষে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করত কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানি করেছে। তবে ব্যবসার পরিধি ও বিনিয়োগ অনুযায়ী আশানুরূপ কার্যাদেশ না পাওয়া, যথাসময়ে কার্যাদেশ পাওয়া জাহাজ সরবরাহ করতে না পারা এবং পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে ক্রমেই পতনের দিকে গেছে কোম্পানিটির ব্যবসা।

অর্থ বাণিজ্য