দেশের ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থদফা আলটিমেটাম

দেশের ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থদফা আলটিমেটাম

দেশের ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থদফা আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভাড়া বাড়ি থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আগামী ১ জানুয়ারি থেকে নতুন ছাত্রছাত্রী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে অস্থায়ী ক্যাম্পাস অবৈধ ঘোষণা করা হবে ।

২৭ মার্চ ইউজিসিতে অনুষ্ঠিত সভায় আলটিমেটাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্তের কথা রোববার জানানো হয়েছে। সাময়িক সনদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, অথচ স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পুরোপুরি স্থানান্তরিত করেনি-এমন ২৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে গত নভেম্বরে ৩ থেকে ৫ দিনের সময় দিয়ে শোকজ করা হয়েছিল। ওই শোকজের জবাব পর্যালোচনার পরই এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো।

আইন লঙ্ঘন করে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গত এক যুগে দেওয়া এটি চতুর্থ আলটিমেটাম। সর্বশেষ তৃতীয়দফার আলটিমেটামে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন বলা হয়েছিল-নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভর্তি বন্ধের কথা ছিল। কিন্তু ওই আলটিমেটাম উপেক্ষিত হয়েছে। এর বিপরীতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি ৪ বছরে কোনো মিটিং পর্যন্ত হয়নি। অবশ্য ইউজিসি একাধিক দফায় বিষয়টি অবহিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, এর নেপথ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পার করে দেওয়ার বিষয় থাকতে পারে। চট্টগ্রামের ওই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ক্যাম্পাস আছে। সবকটিকে স্থায়ী ক্যাম্পাসের মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে ইউজিসির ওপর দীর্ঘদিন চাপ ছিল। কিন্তু আইনে অখণ্ড জমিতে ক্যাম্পাস থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। ইউজিসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা আইনের দিকটি উল্লেখ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করে আসছিল। এজন্য দুই কর্মকর্তাকে ইউজিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তর পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যাশ পূর্ণ হয়েছে। এরপরই এই নতুন আলটিমেটাম এলো কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ অবশ্য বলেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পার হয়েছে কিন্তু স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি, শুধু তাদের শোকজ করা হয়েছে। এরপর শোকজের জবাব সামনে রেখে নতুন আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এখানে অন্য কোনো বিবেচনা প্রাধান্য পায়নি।

দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে ৯৯টির কার্যক্রম চলছে, এর মধ্যে ২০১০ সালের আগের আইনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫২টি। এগুলোর মধ্যে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ আদালতে এক মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সরকার বন্ধ করে দেয়। অবশিষ্ট ৫১টির মধ্যে ২৮টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। বাকি ২৩টি স্থায়ী ক্যাম্পাস বানায়নি। আবার কয়েকটি কোনো ধরনেরই পদক্ষেপ নেয়নি। এমন বাস্তবতায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে ২০১০ সালের পর থেকে সরকার আলটিমেটাম দিয়ে আসছে।

সূত্র জানায়, ২৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল। ২০০২ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ক্যাম্পাস ঢাকার বাইরে। এরপরও ঢাকার শুক্রাবাদে ২টি ক্যাম্পাসে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের কার্যক্রম চলছে। শোকজের জবাবে তারা আগামী বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এখানেই কার্যক্রম চালানোর কথা জানায়। এটা মানতে নারাজ ইউজিসি। তাদের কার্যক্রম এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কোনো প্রোগ্রামেই নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। এছাড়া ক্যাম্পাস দুটি অবৈধ ঘোষণা করা হবে।

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগং (ইউএসটিসি) শোকজের কোনো জবাবই দেয়নি। এ অবস্থায় স্থায়ী ক্যাম্পাস সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ইউজিসির সংশ্লিষ্ট সদস্যের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। এতে অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সদস্য হিসাবে রাখা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ স্থায়ী ক্যাম্পাসে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

এবারও ব্যর্থ হলে সব অস্থায়ী ক্যাম্পাস অবৈধ ঘোষণা, শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫(৭) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়লেও রিসার্চ সেন্টারের নামে ধানমন্ডি এলাকায় ক্যাম্পাস ধরে রেখেছে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বনানী ও গ্রিন রোডে ক্যাম্পাস আছে। সাতারকুলে তৈরি স্থায়ী ক্যাম্পাসেও প্রতিষ্ঠানটি আংশিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে এরপরও অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালাতে চায় তারা। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দুইভাগে পরিচালিত হচ্ছে। একটি আছে গুলশানে, আরেকটি আশুলিয়ায়। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৫৫ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিও দুইভাগে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের আদাবরে ৪টি প্রোগ্রামের কার্যক্রম চলছে। বাকি কাজ চালাচ্ছে ইকবাল রোডের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে। একই পরিস্থিতি সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের। বনানীতে আছে প্রতিষ্ঠানটির অস্থায়ী ক্যাম্পাস, আর তেজগাঁওয়ে স্থায়ী। তবে প্রতিষ্ঠানটির ৪টি অননুমোদিত ক্যাম্পাস আছে। যে কারণে ইউজিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকায় এটি লাল তারকাভুক্ত হিসাবে চিহ্নিত। শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটির উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে আছে স্থায়ী ক্যাম্পাস। কিন্তু এরপরও একই এলাকার ১৩ নম্বর সেক্টরে ও লালমাটিয়ায় ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় চাচ্ছে। এরপর তারা ডেমরায় গ্রিন মডেল টাউনে কার্যক্রম স্থানান্তর করবে। আর স্টেট ইউনিভার্সিটি চাচ্ছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এই প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় দুটি ঠিকানায় ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস বানাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। তবে চলতি বছরের মধ্যেই বনানী থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে আশকোনায় স্থায়ীভাবে কার্যক্রম শুরু করতে চায় নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি ২০২৭ সালে যেতে চায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে। আর ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলেছে ২০২৬ সালে। দুটি প্রতিষ্ঠানই ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। আশা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পেয়েছে ২০০৬ সালে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কোনো সদিচ্ছাই নেই বলে মনে করছে ইউজিসি।

উত্তরা ইউনিভার্সিটি বলছে, ২০২১ সালে এক নির্দেশনায় তাদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। অননুমোদিত ২টি ক্যাম্পাসসহ চলছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠানটি কবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাবে তা জানায়নি। তবে বলেছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাবে। রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা বলছে, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ইতঃপূর্বে গাজীপুর ও ভৈরবে জমি কিনেছে। কিন্তু তারা এখন ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবছে। এজন্য ঢাকায় তেজগাঁওয়ে জমি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। আগামী বছরের মধ্যে এই কাজ তারা শেষ করতে চায়। লাল তারকাভুক্ত ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ অননুমোদিত ৮টি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। ধানমন্ডিতে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কিনেছে। কবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাবে তা জানায়নি।

স্থায়ী ক্যাম্পাসে দুটি ভবনের মধ্যে একটি তৈরির কাজ শেষ করেছে গ্রিন ইউনিভার্সিটি। আরেকটি ১০তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। তবু এ প্রতিষ্ঠানটির আরও ২ বছর লাগবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে। এজন্য ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় চাচ্ছে। দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি মতিঝিলে অপর্যাপ্ত ও ফাউন্ডেশনের নামে রেজিস্ট্রিকৃত জমিতে গড়া ক্যাম্পাসে চালাচ্ছে কার্যক্রম। একইভাবে অপর্যাপ্ত জমিতে কার্যক্রম চলছে প্রাইম ইউনিভার্সিটির। এর মধ্যে অবশ্য প্রথমটিকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়টি কোনো আলটিমেটাম দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষা