দেশের গ্যাস রিজার্ভ ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছবে ২০৩০ সালে

দেশের গ্যাস রিজার্ভ ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছবে ২০৩০ সালে

প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রতিবছর গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। দেশে বর্তমানে যে হারে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশের গ্যাস রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে ২০৩০ সালে ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালে দেশে গ্যাসের ঘাটতি হবে ৩৯০৩ এমএমসিএফডি এবং ২০৩০ সালে ঘাটতি হবে ৫৫৮৭ এমএমসিএফডি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রতিবেদনটি উত্থাপিত হয়।

বিইআরসির ২০২০-২১ অর্থবছরের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস খাত থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশে এ পর্যন্ত মোট ২৮ দশমিক ৩০ টিসিএফ গ্যাস (২পি) আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ১৮ দশমিক ৭০ টিসিএফ গ্যাস। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে মাত্র ৯ দশমিক ৬০ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় শূন্য দশমিক ৮৯ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছিল এবং দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রসমূহ থেকে উৎপাদিত গ্যাস চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় বিদেশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় গ্যাস গ্রিডে ২০২০-২১ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ২১৬ টিসিএফ আরএলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে। গ্যাস সেক্টর মাস্টার প্ল্যান-২০১৭ থেকে প্রাপ্ত ২০২০-২১ থেকে ২০৪০-৪১ পর্যন্ত প্রাক্কলিত গ্যাস রিজার্ভ, চাহিদা, উৎপাদন ও সরবরাহ সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে হারে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশের গ্যাস রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে ২০৩০ সালে ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। গ্যাস সেক্টর মাস্টার প্ল্যান-২০১৭ অনুসারে ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ছিল প্রায় ৪৩০০ এমএমসিএফডি যার বিপরীতে মোট সরবরাহ ছিল দৈনিক ৩০১২ এমএমসিএফডি। এর মধ্যে দেশীয়ভাবে প্রায় ২৪২০ এমএমসিএফডি গ্যাস এবং প্রায় ৫৯২ এমএমসিএফডি আরএলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশীয় সরবরাহের বিপরীতে দৈনিক প্রায় ১৮৮০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবাহের ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি যথাক্রমে ২০২৫ সালে ৩৯০৩ এমএমসিএফডি ও ২০৩০ সালে ৫৫৮৭ এমএমসিএফডি হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয়ভাবে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। দেশীয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি না করা গেলে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি বা পাইপলাইন গ্যাস অথবা বিকল্প জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এলএনজি আমদানি বৃদ্ধি করে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করা হলে গ্যাসের সরবরাহ মূল্য অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে, যার ফলস্বরূপ জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল চাপ পড়বে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য দেশীয়ভাবে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন। সে লক্ষ্য পূরণে সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ভোক্তাদের সহায়তায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে।

গ্যাস ব্যবহারে নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে পাইপলাইন গ্যাস থেকে দুর্ঘটনায় অনেক জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। গ্যাস লিকেজ এসব দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। লিকেজ চিহ্নিত করার জন্য কমিশন গ্যাসে গন্ধ মেশানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে সংশ্লিষ্টদের পত্র দিয়েছে এবং তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে। দুর্ঘটনা রোধে এলপিজির ক্ষেত্রে অনুরূপ গন্ধ মেশানোসহ অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিইআরসি গুরুত্বারোপ প্রদান করেছে।

সিস্টেম লসের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্যাসফিল্ড ও এলএনজি থেকে জাতীয় গ্রিডে গড়ে দৈনিক ৩০১২ এমএমসিএফডি গ্যাস ট্রান্সমিশন করা হয়েছে। কিন্তু ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিসমূহ ২৭৮৫ এমএমসিএফডি গ্যাস বিতরণ করেছে অর্থাৎ প্রতিদিন ২২৭ এমএমসিএফডি গ্যাসের (৭.৫৪ শতাংশ) হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না যার বার্ষিক আর্থিক মূল্য প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা (প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য ৯.৮০ টাকা হিসেবে)।

এ ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ থেকে বিতরণ কোম্পানির এলাকাভিত্তিক সব গ্রাহকের ক্ষেত্রে যথাযথ মিটারিংয়ের ব্যবস্থা ও নিয়মিতভাবে হিসাবরক্ষণ এবং ইনভেন্টরি করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রতি মাসে সিস্টেম লস হিসাব করে তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হবে। যথাযথভাবে গ্যাসে গন্ধ যুক্ত করে পাইপের ছিদ্র শনাক্তকরণ, মেরামত ও পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। অবৈধ গ্যাস লাইন ও সরঞ্জাম অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারকারী ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে গ্যাস আইন-২০১০ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা হলে অচিরেই সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪টি নতুন ক্যাপটিভ লাইসেন্সের আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ৩৫ দশমিক ৯ মেগাওয়াট। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ক্যাপটিভ পাওয়ার ক্যাটাগরির বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহের (৮১৩টি) সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২২০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০টি ক্যাপটিভ পাওয়ার ক্যাটাগরির বিদ্যুৎকেন্দ্রকে (অনূর্ধ্ব ১ মেট্রিক টন ক্ষমতার) ওয়েভার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। উক্ত ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ মেগাওয়াট। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ক্যাপটিভ পাওয়ার ক্যাটাগরির ২৫৩২টি ওয়েভার সার্টিফিকেট-বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩১৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ক্যাপটিভ পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ওয়েভার সার্টিফিকেটসহ) সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫৩৭ মেগাওয়াট।

এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাস সম্পদ ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের সঞ্চালন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, উক্ত খাতে ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, ট্যারিফ নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনয়ন, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বিইআরসি কাজ করছে। ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণসহ অসাধু ও একচেটিয়া ব্যবসা সম্পর্কিত বিরোধের উপযুক্ত প্রতিকার নিশ্চিত করতে কমিশন ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি খাতে সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সুপারিশও প্রণয়ন করা হয়েছে।

জাতীয়