পাহাড়ি ঢলে বন্যায় দুর্ভোগ চরমে

পাহাড়ি ঢলে বন্যায় দুর্ভোগ চরমে

চারদিকে থইথই পানি। নিত্যপণ্যের আগুনমূল্যে জীবন যখন দুর্বিষহ, ঠিক তখনই পাহাড়ি ঢলে সিলেট নগরের লাখো পানিবন্দি মানুষ ভয়াবহ অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছেন। তবে স্বস্তির কথা বৃষ্টির বেগ এবং উজানের ঢলের তোড় কমে আসায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। কমছে নদ-নদীর পানি।

প্লাবিত অঞ্চলগুলো থেকে পানি নামছে ধীরে ধীরে। নগরে পানি কিছুটা কমলেও কমেনি বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীনতা, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি উপদ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ।

সিলেটে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। তবে পানি পুরোপুরি নেমে যেতে চার থেকে পাঁচদিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেটে সুরমা নদীর পানি কমলেও বাড়ছে কুশিয়ারার পানি। ফলে নগরসহ আশপাশের এলাকার পানি কিছুটা কমলেও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে দুর্ভোগ এড়াতে সিলেট শহর ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকে। গত শুক্র ও শনিবার নগরের প্লাবিত এলাকার অনেক বাসিন্দাকে নগর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে দেখা যায়। নগরের শামিমাবাদ এলাকার এক মোদি দোকানি গতকাল পরিবার নিয়ে গ্রামে যাচ্ছিলেন।

তিনি জানান, বাসায় পানি, দোকানেও পানি। এদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ নেই, খাবার পানি নেই। এভাবে কয়দিন টেকা যায়। ব্যবসা বন্ধ, অথচ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। পানিও কিনে খেতে হচ্ছে। তাই গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছি। পানি কমলে আসব।

সিলেট নগরীর বাসিন্দারা বলছেন, পানি কিছুটা কমলেও কমেনি বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ। বাসাবাড়ি থেকে পানি নামায় অনেকে ফিরলেও ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

নগরীর উপশহর এলাকার আব্দুস শহীদ বলেন, পাঁচদিন পর বাসায় ফিরলেও পানিতে অনেক জিনিস নষ্ট হয়েছে। ময়লা ও পচা দুর্গন্ধে বাসায় এখন থাকার মতো পরিবেশ নেই।

গৃহিণী শিরিন আকতার বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীন অবস্থার পাশাপাশি খাবার পানির সংকট পরিস্থিতিকে চরম আকার ধারণ করেছে। এভাবে তো বাসায় থাকা যায় না। বিশেষ করে যেসব মানুষ নিচতলায় বসবাস করেন, বন্যায় মূলত তাদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। অনেকে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন; বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। বন্যার পানি উঠেছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায়ও।

এসব এলাকায় মেস করে থাকেন হাজারো শিক্ষার্থী। মেসে পানি উঠে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। মেস ছেড়ে তাই গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। পুরো জেলার ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বন্যার্তদের জন্য ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবারের মতো শনিবারও সুরমার পানি কমা অব্যাহত আছে। শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের দিনের চাইতে কয়েক সেন্টিমিটার পানি কমেছে। তবে কুশিয়ারা নদীর পানি দুই সেন্টিমিটার বেড়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে। পানি উঠে গেছে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে। এই বাজারের ব্যবসায়ী সুমন পাল বলেন, শুক্রবার রাত থেকে বাজারে পানি উঠতে শুরু করেছে।

এভাবে পানি বাড়তে থাকলে দোকানপাটও তলিয়ে যাবে। এর আগে শুক্রবার মধ্যরাতে সুরমা ও কুশিয়ারার এই উৎসস্থলের একটি বাঁধ ঢলে ভেঙে যায়। ফলে ওই উপজেলার বারোঠাকুরি, কসকনকপুর, কাজলশাহ সুলতানপুর ইউনিয়নে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি এখনো নামেনি। সরকার বন্যার্তদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে এবং কিছু স্থানে সময় বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট জেলার কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

অন্যদিকে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বাড়ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানিও বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট (সিলেট), সিলেট, সুনামগঞ্জ; কুশিয়ারার পানি অমলশীদ (সিলেট) ও শেওলা (সিলেট); পুরোনো সুরমার পানি দিরাই (সুনামগঞ্জ) এবং সোমেশ্বরী নদীর পানি কমলাকান্দায় (নেত্রকোনা) বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাপাউবো।

দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলে গত ১৪ মে থেকে সিলেটে বন্যা শুরু হয়। এরপর তা ক্রমে অবনতির দিকে যেতে থাকে। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চলেও বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। তবে ইতোমধ্যে সিলেটে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে।

কমলগঞ্জে প্রতিরক্ষা বাঁধে ফাটল : ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি স্থান
আমাদের কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ধলাই নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রতিরক্ষা বাঁধ এখন নড়বড়ে অবস্থা। বর্ষা আসতে না আসতেই শুরু হয়েছে প্রতিরক্ষা বাঁধে ধস। ধলাই নদীর ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামত করলেও নতুন করে কয়েকটি স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গত শুক্রবার বিকালে পানি বাড়ায় কমলগঞ্জ পৌর এলাকার করিমপুরসহ আরও পাঁচটি স্থানে নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে আরও ১০টি স্থান। খবর পেয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর এলাকায় ঝুকিঁপূর্ণ বাঁধ পরির্দশন করেন। কমলগঞ্জে ফাটল অংশ পরিদর্শন করে দ্রুত মেরামতের আশ্বাস দিয়েছেন।

গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বিভিন্ন ভাঙন ধরা স্থান পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামত করলেও বর্তমানে কয়েকটি স্থান অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। গত এক সপ্তাহের ভারী বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদীর বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ হওয়ায় পানি বৃদ্ধিতে বাঁধে ফাটল বা ধস দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার ইসলামপুর ইউপির মোকাবিল, কালারায়বিল, হোমেরজান, ভাণ্ডারীগাঁও, আদমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ তিলকপুর, উত্তর ঘোড়ামারা, রানীরবাজার, মাধবপুর ইউনিয়নের কাটাবিল, শুকুর উল্লাহগাঁও, ধলাইরপার, কমলগঞ্জ পৌর এলাকার আলেপুর, করিমপুর, বড়গাছ ও উজিরপুর, মুন্সীবাজার ইউনিয়নের খুশালপুর, রহিমপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুরসহ প্রায় ১০টি স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

অপরদিকে আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নদ-নদী ও হাওরে পানি বেড়েই চলছে। এতে অনেক রাস্তাঘাট, হাট-বাজার ও ঘরবাড়িতে উঠছে পানি। নিম্নাঞ্চলের পানিবন্দি মানুষ দিশেহারা হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চারদিকে ছোটাছুটি করছেন। অনেকে উঁচু স্থানে স্কুল ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার অনেকে নিজ ঘরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান করছেন।

নেত্রকোনায় বন্যার শঙ্কা : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দার উব্ধাখালী নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কলমাকান্দায় ৪০ মিলিলিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অতিবৃষ্টিতে সীমান্তবর্তী গণেশ্বরী, মঙ্গলেশ্বরী, মহাদেও ও মহেষখোলা নদীর পানিও বেড়ে চলছে। অন্যদিকে, পাহাড়ি ঢলের কারণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে উব্ধাখালি নদী। এতে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে কলমাকান্দা উপজেলায় বন্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সিরাজগঞ্জে বিপদসীমা ছুঁইছুঁই যমুনার পানি : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে বেড়েই চলেছে যমুনা নদীর পানি। এতে একদিকে যেমন যমুনার পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে, অন্যদিকে বন্যার আশঙ্কা করছেন নদী পাড়ের মানুষ। গত ১৮ ঘণ্টায় (গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত) যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধ এলাকায় ২৪.২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে যমুনা পাড়ের নতুন নতুন এলাকা।

অন্যদিকে যমুনায় ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ প্রস্তুত করছে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক হাসানুর রহমান বলেন, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধ এলাকায় পানির বিপদসীমা ধরা হয় ১৩ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার। গতকাল বিকাল ৩টায় সর্বশেষ পানি রেকর্ড করা হয় ১২ দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার। গত ১৮ ঘণ্টায় ২৪ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপদসীমার ১ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সারাদেশ