অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা ভোগের জন্য আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়েছে। কারাগারে তিনি পাবেন ডিভিশন সুবিধা। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, তাকে কারাগারে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান ও কারাগারের তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নতমানের হাসপাতালে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’ দিতে বলা হয়েছে। এদিকে হাজী সেলিমের আইনজীবী জানিয়েছেন ফের জামিন আবেদন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়।
আদালতের আদেশের পর বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে আদালত থেকে পিকআপ ভ্যানে করে তাকে নিয়ে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওয়ানা হয় পুলিশ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে কারাগারে পৌঁছে তাকে বহন করা পুলিশের গাড়িটি। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম বলেন, সাজা পরোয়ানা মূলে আসামি হাজী সেলিমকে কারাগারে নেয়া হয়েছে। জেলকোড অনুযায়ী ডিভিশন-১ দেয়া কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা থাকলে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত। সে অনুযায়ীই হাজী সেলিমকে ডিভিশন-১ এ পাঠানো হয়েছে। রবিবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন তিনি। আদালত শুনানি শেষে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আবেদনে হাজী সেলিমের আইনজীবী প্রাণ নাথ উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালে হার্ড সার্জারির সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন যাবত বাক-শক্তিহীন অবস্থায় রয়েছেন হাজী সেলিম। তিনি দেশ বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। জেল হাজতে থাকলে চিকিৎসার অভাবে ও বাক-শক্তিহীনের কারণে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে যে কোন শর্তে তার জামিন আবেদন করা হয়েছে। জামিন দিলে তিনি পলিয়ে যাবেন না। তাই আপীল শর্তে আত্মসমর্পণের পর তার জামিনের আবেদন করা হয়েছে। কারাগারে উন্নত চিকিৎসা ও প্রথম শ্রেণীর ডিভিশন চেয়ে আরও দু’টি আবেদন করা হয়েছে।
গত ২৫ এপ্রিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালতে হাইকোর্ট থেকে মামলার নথি এসে পৌঁছায়। এদিন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে রায়ের নথি পাঠানো হয়। দুদকের আইনজীবী মোঃ খুরশীদ আলম খান বলেন, আইন অনুযায়ী রবিবার থেকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর হাইকোর্টের রায়ের ফলে তার সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এরআগে হাজী সেলিমকে বিচারিক (নিম্ন) আদালতে দেয়া ১০ বছরের কারাদ- ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
২০২১ সালের ৯ মার্চ বিচারপতি মোঃ মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া জরিমানার টাকা অনাদায়ে, হাজী সেলিমকে আদালত আরও এক বছরের সশ্রম কারাদ-ের নির্দেশ দেন এবং রায় প্রকাশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। আত্মসমর্পণ না করলে জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিরও নির্দেশ দেন। এছাড়া জব্দ করা হাজী সেলিমের সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াফত করতে বলা হয়।
২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এরপর ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল হাজী সেলিমকে ১৩ বছরের কারাদন্ড দেন আদালত। পরে ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর হাজী সেলিম এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করেন। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেন। এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করে দুদক। শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের ওই রায় বাতিল করেন আপীল বিভাগ। সেই সঙ্গে হাজী সেলিমের আপীল পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায় দেন হাইকোর্ট। সেখানে বিচারিক আদালতের দেয়া ১৩ বছরের কারাদন্ড কমিয়ে ১০ বছর বহাল রাখা হয়।
ফের জামিন আবেদন করব হাজী সেলিমের আইনজীবী ॥ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেছেন, এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা। এটি তিনি ভাল করেই জানেন। এটি তার ব্যক্তিগত কোন বিষয় নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আছেন বলেই আজ তাকে জেলে যেতে হলো। আর এতে তিনি একেবারেই বিচলিত নন। রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় আদালত থেকে বেরিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
এর আগে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে হাজী সেলিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। হাজী সেলিম শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তার চিকিৎসার আবেদন করা হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী বলেন, আপনারা সবাই জানেন, আজ থেকে পাঁচ বা সাত বছর আগে তিনি একটা দুঃখজনক ঘটনায় বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে আছেন। এই সমস্যা আমরা সবাই জানি। এজন্যই চিকিৎসার জন্য আমরা বলেছি। তাকে যেন হাসপাতালে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, আদালতের দেয়া আদেশের কপি আমরা শীঘ্রই হাতে পাব। তারপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে আগামী রবিবার আদালতে জামিন আবেদন করব।
আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা জোরদার ॥ হাজী সেলিমের আগমন উপলক্ষে ঢাকা এজলাস কক্ষের বাইরে ও আদালতের প্রবেশ মুখে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ সময় আদালতের বাইরে নেতাকর্মীরা ভিড় করেন।
সেলিমের জন্য কারাগার হাসপাতাল একই ॥ আদালত কর্তৃক কারাগারে পাঠানোর আদেশের খবরে হতাশ হাজী সেলিমের কর্মী-সমর্থকরা। তবে তারা বলছেন, তার জন্য কারাগার নতুন কিছু না। তার জন্য এখন কারাগার ও হাসপাতাল একই। আদালতের আদেশের পর উপস্থিত লালবাগ ছাত্রলীগের কর্মী মুন্না বলেন, হাজী সেলিম বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকেন। সমস্যায় পড়লে ডাকলে সাড়া দেন। আজ তার বিপদ। আজ তার কারাগারে যেতে হবে ভেবেই এখানে এসেছি। সমর্থকরা বলেন, তিনি এর আগেও জেল খেটেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা মামলা ছিল সম্পূর্ণ একপেশে। সেই মামলায় এত বছর পর তাকে কারাগারে যেতে হবে ভাবিনি। তবে তার জন্য জেলখানা নতুন কিছু না। তিনি এখন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। তার জন্য কারাগারে থাকা কঠিন, হাসপাতালেই থাকবেন তিনি।
আদালতে আবেগাপ্লুত সেলিমপুত্র সোলায়মান ॥ আদেশ পাওয়ার পর অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন তার সঙ্গে আসা দুই সন্তান ও কর্মী সমর্থকরা। গণমাধ্যমকর্মীরা যখন সেলিমপুত্র হাজী সোলায়মানের কাছে সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চান তখন কথা বলতে গিয়ে বারবার গলা ধরে আসছিল তার। তবে তার বিশ্বাস সত্যের জয় হবে। তার বাবা ন্যায়বিচার পাবেন। হাজী সোলায়মান বলেন, ‘সবাই জানে ১/১১ এর সময়ের তথাকথিত সরকার আজকের প্রধানমন্ত্রীসহ তার ঘনিষ্ঠ ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। সেই মামলায় তখনকার ক্যাঙ্গারু কোর্ট সাজা দিয়েছিল। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আজকে আদালতে এসেছেন তিনি। এখন আমরা উচ্চ আদালতে যাবো। সোলায়মান সেলিম বলেন, ‘আমার বাবা দলের দুঃসময়ের কান্ডারি ছিলেন। অসংখ্য নেতাকর্মী গড়ার কারিগর তিনি। দলের জন্য, এলাকার মানুষের জন্য অনেক করেছেন। আমার বাবা খুব অসুস্থ, তিনি নিজে নিজে চলতে পারেন না। শারীরিক সুস্থতার জন্য তার চিকিৎসা প্রয়োজন।’