ভোটার তুষ্টির প্রকল্প নিয়ে নির্বাচনী মাঠে এমপিরা

ভোটার তুষ্টির প্রকল্প নিয়ে নির্বাচনী মাঠে এমপিরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো দেড় বছরের বেশি সময় বাকি। তবে এখন থেকেই সংসদ সদস্যরা এলাকায় বেশি সময় দিতে শুরু করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের আগের বছর ভোটার তুষ্টির জন্য নানামুখী প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এরই একটি সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এমপিদের নিজ এলাকায় পছন্দের মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, ঈদগাহ, শ্মশানসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে গৃহীত এক হাজার ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি এরইমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) অনুমোদন পেয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি এমপি ৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারবেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ এটি বাস্তবায়ন করবে। পুরো টাকা সরকার নিজস্ব উৎস থেকে দেবে।

এ ছাড়া ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’; ‘বরিশাল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প; নওগাঁ সড়ক বিভাগাধীন ৩টি আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৩টি জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ প্রকল্পও অনুমোদন পেয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত নির্বাচনী মাঠে এমপিদের জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ভোটের আগে জনগণের কাছাকাছি গিয়ে তাদের সামাজিত দাবি মেটাতে এসব প্রকল্প খুবই সহায়ক হবে। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনী প্রকল্পের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এমপিদের ভূমিকা বিচ্যুতি হচ্ছে বলে মনে করছেন। তাদের মতে, প্রকল্প গ্রহণ কিংবা বাস্তবায়ন এমপিদের কাজ নয়। আইন প্রণয়নই তাদের মূল কাজ। নির্বাচনী প্রকল্প গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে তারা বলছেন, সামাজিক উন্নয়ন নয় বরং জনগণের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণটাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা তাতে এ ধরনের প্রকল্প নেয়া এবং নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প চালু রাখা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এমন সব উদ্যোগ দরকার যাতে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কৃষি উৎপাদন খরচ কম হয়। এজন্য সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর হতে হবে। পণ্যেমূল্যেও লাগাম টানায় কাজ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। সরকারকে কঠোর হাতে এসব বন্ধ করতে হবে। আর এসব করতে পারলেই জনগণের মুখোমুখি হওয়া সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এই পরিস্থিতিতে এমন প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন নামের এই প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, কোথায় কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা হবে, সেটি ঠিক করবেন স্থানীয় এমপি। তবে তিনি স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানাবেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ওই সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভবন, দেয়াল নির্মাণ, আসবাবপত্র সরবরাহসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন করে দেবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী এই প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। আগামী ৩ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ১৭ হাজার ৩২১টি সামাজিক ও ধর্মীয় স্থাপনায় এই প্রকল্পের অর্থ খরচ করা হবে। শুরুতে এ প্রকল্পে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মূল্যায়ন কমিটির সভায় তা কমিয়ে ১ হাজার ৮২ কোটি টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকার নিজস্ব খাত থেকে পুরো টাকার জোগান দেবে। এতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রকল্পটি সারা দেশে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে সিটি করপোরেশন এলাকা এর বাইরে থাকবে। দেশে বর্তমানে ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। সে হিসাবে প্রতি উপজেলায় গড়ে ২ কোটি টাকা খরচ করা হবে। আর সংরক্ষিত আসনসহ মোট সংসদ সদস্য রয়েছেন ৩৫০ জন। সে হিসাবে একেকজন সংসদ সদস্য নিজ এলাকায় সামাজিক অবকাঠমো উন্নয়নে গড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সুযোগ পাবেন।

এর আগে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে ‘সর্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ নেয়া হয়। তাতে খরচ ধরা হয় ৬৬৫ কোটি টাকা। এতে প্রতিটি উপজেলার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ কোটি টাকা খরচ করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, উন্নয়ন টেকসই করতে জনগণের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন অপরিহার্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘সর্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের সুপারিশকৃত স্কিমগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

দেশের জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী করতে সামাজিক সমাবেশ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য সামাজিক অবকাঠামো অপরিহার্য। আগের প্রকল্প সফল বাস্তবায়নের কারণে সরকারি খাস বা দান করা জমিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা অবকাঠামো জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটিতে এমপিদের সম্পৃক্ত না করে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সরাসরি করাটাই উত্তম হতো।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনে এমপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটি পুরোপুরি জনতুষ্টির প্রকল্প। সাধারণত মসজিদ-মন্দিরের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় জনগণ নিজেদের উদ্যোগেই উন্নয়ন করে থাকে। সরকারের নিজের থেকে এসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের খুব বেশি দরকার পড়ে না। তার মতে, প্রকল্প নেয়া এমপিদের কাজ নয়; আইন প্রণয়ন করাই তাদের দায়িত্ব। এভাবে স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে এমপিদের ভূমিকার বিচ্যুতি হচ্ছে।

জাতীয়