খেলাপির ভারে অস্থির ব্যাংক খাত। করোনাকালীন বিশেষ সুবিধা তুলে নেয়ার পরপরই এটি আরও বেসামাল। লাগামহীন বাড়তে থাকা অনাদায়ী ঋণে দুশ্চিন্তায় খাত-সংশ্লিষ্টরা। আমানতকারীদের শঙ্কিত হওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে। খেলাপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা প্রভিশন ঘাটতি ভয়ের সঞ্চার করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, পুরো ব্যাংক খাতই ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হলো ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করা। এ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থতায় সবচেয়ে এগিয়ে সরকারি ও বেসরকারি আট ব্যাংক।
তবে একেবারে নাজুক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। পুরো ব্যাংক খাতের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকেই প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৮ হাজার ১৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে সরকারি-বেসরকারি ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে জমা রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি।
মার্চ শেষে পুরো ব্যাংক খাতের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভিশনে ঘাটতি থাকলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। তাই যেসব ব্যাংকের ঘাটতি আছে, তাদের নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দ্রুত পূরণ করতে হবে। অন্যথায় আমানতকারীরা ঝুঁকিতে পড়বেন।
নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ (খেলাপি) ঋণে পরিণত হলে তাতে ব্যাংক যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ৮ ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের রয়েছে চার ব্যাংক। যাদের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্চ শেষে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে থাকা জনতা ব্যাংকের পরই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশনে ঘাটতি আছে ৪ হাজার ১০৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ২২৫ কোটি ৪১ লাখ ও রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্চ শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৩১ কোটি ২৩ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৩১ লাখ ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। তথ্যমতে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশে বিতরণ করা মোট ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায়। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।