আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের কদর বাড়ছে। নির্বাচন এলেই নামসর্বস্ব এসব দলের দৌড়ঝাঁপ বাড়ে, সেই সঙ্গে স্বগোত্রীয় বড় দলের কাছে বাড়ে তাদের নানামুখী আবদার। দেশে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের স্বার্থে সেই আবদারের গুরুত্বও বাড়িয়ে দেয়। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের হিসাব অনেক জটিল ও কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দল নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না যাওয়ার কথা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বেশ তৎপর। ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে টানার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বড় দুই জোটে। এবারও এর ব্যক্তিক্রম নয়।
আগামী নির্বাচনে নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মূল লক্ষ্য। এজন্য দূরে সরিয়ে রাখা জোটের শরিকদের কাছে টানছে দুদলই। অন্যদিকে দুই দলের বাইরে থাকা ছোট দলগুলোও চাইছে আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেতৃত্বাধীন যেকোনো জোটে যুক্ত হতে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও বেশ আগে থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না গেলেও রাজপথে নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে প্রধান দুই দলই নিজ নিজ জোট শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় মহাজোট ও ১৪ দল শরিকদের কারো ঠাঁই মেলেনি। এমনকি ওই সময়ই প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা ১৪ দল শরিকদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর কিংবা বিরোধী দলে থেকে নিজ নিজ দলীয় কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দেন। পরবর্তী নির্বাচনে শরিকদের নিজ নিজ প্রতীকে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিতও দেন প্রধানমন্ত্রী। এসব বিষয় ১৪ দল শরিক নেতাদের যেমন ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল, তেমনি গত তিনবারের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জোটগতভাবে হবে কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল।
প্রায় তিন বছর পর গত ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরিক দলের নেতাদের বৈঠকে একসঙ্গে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি ওই বৈঠকে সমন্বয়হীনতা দূর করে জোটের কার্যক্রম জোরদারের তাগিদও দেন। এমনকি জোট শরিকদের এখনই আসন সমঝোতাসহ মূল্যায়নের দাবি পূরণের আশ্বাসও দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এদিকে ২০ দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের অনেক নেতার কর্মকান্ডে অনেকটা অসন্তুষ্ট বিএনপি। ২০ দলের অনেক নেতা বিভিন্ন সময় বিএনপির স্বার্থে বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন। তারপরও বৃহৎ স্বার্থে সেই দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বিএনপি। এরই মধ্যে কল্যাণ পার্টি ও এলডিপিকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসতে সক্ষমও হয়েছে দলটি। এর বাইরে তারা বাম ও ইসলামী দলসহ সরকারবিরোধী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও কাছে টানার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতারা কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে নানা আশ্বাসও দিয়েছেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই সরকারের পতনের পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে রাজপথের আন্দোলনের বিকল্প নেই। এজন্য সব দলকে এক প্ল্যাটফরমে আসতে হবে। বিএনপি বড় দল। তাদেরই এ ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক, রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এসব দলকে বড় দুই দল জোটে টানছে।
জানা গেছে, বিএনপি ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করায় সরকারি দলও নড়েচড়ে বসেছে। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অন্যরা ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। ১৪ দলের ঐক্য বাড়াতেই বেশি ব্যস্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করবে। এ মুহূর্তে মহাজোট সম্প্রসারণের দলীয় চিন্তা না থাকলেও অনেকটা কৌশল থেকেই ছোট দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন তারা। আওয়ামী লীগের নেতারা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তারা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের ভাবনায় সিপিবি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেভাবে ছোট দলগুলোর অফিসে ছুটে চলেছেন, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিলও একইভাবে ছোটাছুটি করেন। এতে ইতিবাচক ফল পেয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলেই ২০০৪ সালে ১৪ দলীয় জোট। এরপর এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এখন টার্গেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করা। এজন্য জোটসহ জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে চলেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কখনো গুলশানে বিএনপির কার্যালয়ে আবার কখনো দলগুলোর কার্যালয়ে বৈঠকে বসছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাসসহ সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে গোটা দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। তাই দলগুলো তাদের নিজেদের আত্মমর্যাদার জন্য যেটা উত্তম সেটাই করবে।