বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী পাচারের টাকা মানুষের হক ফেরত আনার চেষ্টা হচ্ছে ♦ ১ জুলাই থেকে ব্যয় সংকোচনের দিকে যাবে সরকার ♦ রাজস্ব আয় সহায়ক নয় এমন প্রকল্প আপাতত বন্ধ ♦ সরকার ঋণ নিলেও ব্যাংকে অলস টাকা থাকবে ♦ অভিযান চলবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হবে না

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী পাচারের টাকা মানুষের হক ফেরত আনার চেষ্টা হচ্ছে ♦ ১ জুলাই থেকে ব্যয় সংকোচনের দিকে যাবে সরকার ♦ রাজস্ব আয় সহায়ক নয় এমন প্রকল্প আপাতত বন্ধ ♦ সরকার ঋণ নিলেও ব্যাংকে অলস টাকা থাকবে ♦ অভিযান চলবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশে পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক, এগুলো ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল বাজেট-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা কোনো প্রমাণ ছাড়া বলতে পারি না টাকা পাচার হয়েছে। টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে, সরকার তা ফেরত আনার চেষ্টা করছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে পাচারকৃত টাকা কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন সাংবাদিক। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেটা পাচার হয়েছে সেটা এদেশের মানুষের হক। যদি বাধা দিই তবে আসবে না। যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? সে কারণে এই টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বাধা দেওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বাজেট-পরবর্তী এ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী প্রফেসর শামসুল আলম ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে করিম, অর্থ সচিব আবদুর রউফ, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন প্রমুখ। বাজেটোত্তর এ সংবাদ সম্মেলনে গতকাল যেসব প্রশ্ন করা হয়, তার বেশির ভাগই ছিল কর দিয়ে পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ নিয়ে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং আইনে বাধা হবে কি না জানতে চান সাংবাদিকরা। এ সময় মুস্তফা কামাল জানান, বিশ্বের আরও ১৭টি দেশ এ ধরনের অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরতের সুযোগ দিয়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়ে ছাড়াও এশিয়ার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে বলে জানান তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, টাকার একটা ধর্ম আছে। যেখানে সুখ, বিলাস পায়, যেখানে রিটার্ন বেশি পায় সেখানে চলে যায়। টাকা যারা পাচার করে সুটকেসে করে কোনো প্রমাণ রেখে পাচার করে না। এখন ডিজিটাল যুগ। বিভিন্নভাবে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচার করে তারা হয়তো জেনেবুঝে করে না। এ কারণেই কর দিয়ে সেই টাকা ফেরত আনার একটা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর আশা, যারা টাকা পাচার করেছে, তারা এ সুযোগে ফিরিয়ে আনবে। যারা টাকা ফিরিয়ে আনবে তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলেও জানান তিনি। এক সাংবাদিক দেশ থেকে পাচারকৃত টাকার পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের কাছে ওই পরিসংখ্যানের কোনো মূল্য নেই। কারণ তারা পাচারকৃত অর্থের কোনো প্রমাণ পাননি। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরও জানান, সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের কোনো প্রমাণ তারা পাননি। তিনি বলেন, বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচার করে, এমন তথ্য আছে। তবে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়-এমন তথ্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে নেই, আমার কাছেও নেই। ভারতে পি কে হালদারের টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়ার পর তা ফেরত আনা যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা হালদারের পাচারকৃত টাকা ফেরত দেবে। এ ছাড়া হালদারকেও ব্যাক করবে। এমন কি পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গেও সরকারের আলোচনার কথা জানান মন্ত্রী।
ব্যয় সংকোচনের পথে সরকার : আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে সরকার আরও বেশি কৃচ্ছ্রতা অর্থাৎ ব্যয় সংকোচনের পথে যাবে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটে চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোর যে কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেটি দেশের অর্থনীতির ভোগ কমিয়ে দেবে কি না জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ কৌশলের মাধ্যমে খাদ্য চাহিদা বা ভোগ কমানোর বিষয়ে বলা হয়নি। বরং ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের মধ্যে যাতে কোনো মিসম্যাচ না হয় সে নীতি গ্রহণের কথাই বলা হয়েছে। তিনি বলেন, জিডিপি অনুযায়ী যে পরিমাণ বাজেট করার কথা ছিল, এবার সেটি কমানো হয়েছে। এ কারণে কিছু খাতে বরাদ্দও কম দেখা যাচ্ছে। এভাবেই চাহিদা কমানো হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থ সচিবকে ব্যাখ্যা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে অর্থসচিব বলেন, ভোগ কমানোর কোনো নীতিতে যাচ্ছে না সরকার। বরং সরবরাহ ধরে রাখার জন্য উৎপাদনে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য কৃষি খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সচিব বলেন, প্রতিদিন জ্বালানি আমদানিতে বিপিসি ৬৫ কোটি টাকা লোকসান দিলেও দাম বাড়ানো হয়নি। যে দামে সার আমদানি হচ্ছে তার ১০ ভাগের এক ভাগ দামে কৃষককে দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার এসব ভর্তুকি দিচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে একই সঙ্গে অনুৎপাদনশীল খাতে সরকার কৃচ্ছ্রতার নীতি গ্রহণ করবে বলেও উল্লেখ করেন। অর্থ সচিব বলেন, চলতি বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল জিডিপির ১৭ দশকি ৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার কমিয়ে জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটের আকার কমানো ছাড়াও আরও কৃচ্ছ্রতার পথে যাচ্ছি আমরা। ১ জুলাই থেকে আরও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পদ্মা সেতুর মতো যেসব প্রকল্প থেকে এ মুহূর্তে রাজস্ব আসবে, বা সড়ক-ব্রিজের মতো যেসব অবকাঠামো প্রকল্প রাজস্ব আয়ে সহায়তা করবে, আপাতত সেগুলোই বাস্তবায়ন হবে। রাজস্ব আয়ে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে অন্য প্রকল্প আপাতত বাস্তবায়ন করা হবে না। এ সময় কৃষিমন্ত্রী জানান, এবার কৃষি খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বিতরণ করা হয়েছে। এ সহযোগিতা গ্রামের মানুষ পেয়েছে। এটি না দিলে উৎপাদন কমে যেত। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি না হলেও দেশে খাদ্য সমস্যা হবে না। বিজ্ঞানীরা এমন কিছু জাত উদ্ভাবন করছেন যাতে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়ে।

সরকারের ঋণ বাড়লেও ব্যাংকে অলস টাকা থাকবে : ঘাটতি মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ গ্রহণের টার্গেট ধরেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি। ব্যাংক থেকে সরকারের অত্যধিক ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতে বাধা সৃষ্টি করবে কি না এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা। জবাবে অর্থ সচিব জানান, বর্তমানে বাজারে যে মুদ্রাপ্রবাহ চালু আছে সে তুলনায় সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। আরও ৯৪ শতাংশ অর্থ বেসরকারি খাতের জন্য থাকবে। এ ছাড়া সামনের অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি গ্রহণ করবে, তাতে নতুন করে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ মুদ্রাবাজারে প্রবেশ করবে বলে জানান অর্থ সচিব। এর ফলে যে পরিমাণ টাকা বাজারে আসবে তাতে সরকার ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করলেও আরও সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকে অলস পড়ে থাকবে বলে জানান সচিব।

অভিযান চলবে, সরকার ব্যর্থ হবে না : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজারে অস্থিরতা থাকবে। বর্তমানে যে অস্থিরতা এটা সারা বিশ্বের। প্রায় ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে পণ্যের। আমরা দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি; আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তবে বাজারে যাতে অসাধু সিন্ডিকেট সক্রিয় না থাকে সে কারণে অভিযান চলছে। সরকার এখানে ফেল করবে না। বাজেটে কম্পিউটার-মোবাইল আমদানির ওপর ট্যাক্স আরোপ নিয়ে অর্থমন্ত্রী জানান, সরকার ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাই দেশের ভিতরে উৎপাদিত জিনিস দেশের মানুষকে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে আমদানি পণ্যে করারোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বাজেট সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাজেট। যারা ব্যবসায়ী তারা উপকৃত হবেন, যারা কষ্ট করে জীবন ধারণ করেন তারাও উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, আমি এক সময় গরিব ছিলাম। গরিব হওয়া কষ্টের। এ কারণে প্রতিটি গরিব মানুষ যাতে বাজেটের সুফল পায় সে চেষ্টা রয়েছে তার বাজেটে। বাজেটের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের সামনে যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি সম্ভাবনার পথও খুলে গেছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স বাড়ছে। রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজস্ব আয় ১৪ শতাংশ বাড়াতে পারলে এসব চ্যালেঞ্জ থাকবে না বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয়