বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেন তার যেকোনো একটি দিক নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। যেমন গত দুটি বাজেটে বেশি সমালোচনা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি। গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে সে বাজেটে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনলে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না নিয়ে। বাজেট পেশের দিন এবং শুক্রবার অর্থনীতিবিদসহ প্রায় সব মহলেই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু পাচার হওয়া টাকা কি আদৌ ফেরত আসবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পদক্ষেপে পাচার করা অর্থ ফেরার সম্ভাবনা তো নেই, উল্টো আরও বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নানও মনে করছেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। বাজেট পেশের দিন রাতে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, টাকা একবার পাচার হয়ে গেলে সে টাকা কি আর ফেরত আসে। সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নয়, আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব না।
গতকাল এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে পরিকল্পনামন্ত্রী সময়ের আলোকে বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে দেশের টাকাগুলো বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে অনেক উন্নত দেশে চলে গেছে। আমাদের মতো গরিব দেশ ওইসব বড় বড় মোড়লের দেশ থেকে টাকা আনতে পারবে না। আমি মনে করি পাচারের টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে। এ জন্য এর সাফল্যের বিষয়ে আমি সন্দিহান। তবে সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বললে বলতে হয়, সরকার চেষ্টা করছে টাকা ফেরত আনতে, চেষ্টা করে দেখুক। চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাচার হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬১ হাজার কোটি টাকা করে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে টাকা পাচারে রীতিমতো বিরাট উল্লম্ফন ঘটে। এ বছর এসে টাকা পাচার হয় ৮২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরপর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭৪ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে।
জিএফআইর প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয় ২৮ হাজার ৪৭৫ কেটি টাকা, ২০০৫ সালে হয় ৩৬ হাজার ২১০ কোটি টাকা, ২০০৬ সালে ২৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, ২০০৭ সালে ৩৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, ২০০৮ সালে ৫৪ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা, ২০০৯ সালে ৫২ হাজার ১০৫ কোটি টাকা, ২০১০ সালে ৪৫ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ৫০ হাজার ৩২০ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ৬১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা পাচার হয়।
জিএফআইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সালে এক লাফে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে কিছুটা কমে হয় ৭৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে পাচার হয় ৯৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা।
অবশ্য ২০১৫ সালের পর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছিল, বিগত বছরগুলোতে অর্থপাচারের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে। আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৭৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে পাচার হয়েছে আরও ৪ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
আরও জানা গেছে, পাচার হওয়া টাকা মূলত ১১টি দেশে যাচ্ছে বেশি। বাংলাদেশের টাকা বেশি যে দেশে যায় তার মধ্যে শীর্ষে আছে কানাডা। দেশটিতে পাচারের টাকায় বাংলাদেশিরা অনেক বাড়ি কিনেছেন। এ জন্য সেখানে ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার ৩৩ শতাংশ সিঙ্গাপুরে যায় বলে জানা গেছে। এরপর বেশি যায় মালয়েশিয়ায়। তা ছাড়া টাকা পাচারের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সুইস ব্যাংকের নাম। অথচ সুইজারল্যান্ডের এ ব্যাংকটিতে পাচার করা টাকার মাত্র ৫ শতাংশ জমা হয়। অথচ এর চেয়ে বেশি অর্থ যায় আমেরিকা, ব্রিটেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কাতারে। এসব দেশ ছাড়াও নতুন গন্তব্য হিসেবে মিসর, গ্রিস, জার্মানি ও ব্রাজিলের নাম আসছে সামনে। দক্ষিণ আফ্রিকাও এ তালিকায় রয়েছে বলে জানা যায়।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় বৃহস্পতিবার বলেছেন, সঙ্কটকালে আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য একদিকে আমাদের অধিক পরিমাণে রাজস্ব জোগান দিতে হবে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে হবে। এ অবস্থায় বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করা দরকার।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিট্যান্স) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করেন তিনি। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার সুযোগ কেন রেখেছেন তার আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও নরওয়েসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ এই সুযোগ দিয়ে সফলতা পেয়েছে। এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়াও এই সুযোগ দিয়ে বড় সফলতা দেখিয়েছে। আমরাও এ সুযোগ দিয়ে চেষ্টা করে দেখি পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসে কিনা। তবে আমার বিশ্বাস যে, সুযোগ রাখা হচ্ছে তাতে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসবে। আমরা পাচার হওয়া টাকা ফেরত এনে অর্থনীতির মূল ধারায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। এ জন্য যারা টাকা ফেরত আনবে তাদের কোনো রকম প্রশ্ন করা হবে না।
পুরো বাজেটে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের এই অংশটিকে ‘কালো অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
শুক্রবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় বাজেটের বেশি সমালোচনা হয়েছে কালো টাকা নিয়ে। অর্থমন্ত্রী বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত যে বাজেট দিয়েছেন তাতে সবচেয়ে কালো দিক হচ্ছে পাচার হওয়া টাকা বিনা প্রশ্নে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া। এর মাধ্যমে একটি অনৈতিক কাজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হলো। এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে অনৈতিক কাজকে বৈধতা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। তা ছাড়া এ সুযোগ দিলেই যে টাকা ফেরত আসবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ যারা টাকা নিয়ে গেছে, তারা হয় সে দেশে বিনিয়োগ করেছেন, না হয় বাড়ি কিনেছেন। সে টাকা তারা কেন ফেরত আনবে। আমি তো মনে করি এতে উল্টো টাকা পাচার আরও বেড়ে যাবে। কারণ যারা টাকা পাচার করে তারা তো একরকম লাইসেন্স পেয়ে গেল টাকা পাচারের।
অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিদেশ থেকে অর্থ আনার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এটা কখনই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এটা অনৈতিক। একদিকে অর্থপাচারের সুযোগ দিয়ে আবার অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেব; অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য করছাড় থাকবে না, এটা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় বাজেটে এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া শোভন দেখায়নি।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা অর্থপাচার করছে তারা আর্থিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। এই প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো- দেশের টাকা পাচার করাই একটি অনৈতিক কাজ। এটিই তো বড় অপরাধ। এই অনৈতিক কাজকে সরকার কীভাবে এত প্রকাশ্যে বৈধতা দিতে পারে আমার বুঝে আসে না। এটি নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত পদক্ষেপ।