নিজস্ব প্রতিবেদক
বিদেশে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করে জাতীয় সংসদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে একাধিক সংসদ সদস্য বলেছেন, এটি কার্যকর হলে দুর্নীতিবাজেরা উৎসাহিত হবেন। সংসদ সদস্যরা তখন টাকা পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
আজ রোববার জাতীয় সংসদে ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা এসব কথা বলেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই প্রস্তাব নিয়ে ইতিমধ্যে নানামুখী সমালোচনা শুরু হয়েছে। এখনো জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি। তার আগেই সম্পূরক বাজেটের আলোচনায় অংশ নিয়ে আজ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন তিনজন সংসদ সদস্য।
পাচার করা টাকা কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান। তিনি বিদেশে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পীর ফজলুর রহমান বলেন, যাঁরা লুটপাট করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে বিদেশে পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। না হলে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
পীর ফজলুর রহমান আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী এই করোনাকালে মানুষের জীবন রক্ষার যে বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানে একদিকে মানুষকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন, অপর দিকে হাজার হাজার কোটি টাকা এই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সেটা রোধ করতে পারেননি।
জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘যাঁরা অর্থ চুরি করলেন, অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে দিলেন, তাঁদের দায়মুক্তি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এটি সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর (অর্থমন্ত্রী) উচিত ছিল যাঁরা এই করোনাকালে মানুষের ক্রান্তিকালের সময় অবৈধ টাকা অর্জন করে বিদেশে পাচার করেছেন, এই টাকা যাতে পাচার না হয়, সেটার প্রতিরোধ করা বা আটকানো। কিন্তু সেখানে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।’
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে পীর ফজলুর রহমান বলেন, মানুষ সন্দেহ করছে, একটা বিশাল গোষ্ঠী অবৈধভাবে টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করার জন্য বসে আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হবে। যারা অবৈধভাবে টাকা লুটপাট করে সেই টাকা বৈধ করার জন্য এটি নিয়ে আসছে। এটি দায়মুক্তি দিলে মানুষ অবৈধভাবে টাকা উপার্জনে উৎসাহী হবেন।
একদিকে মানুষ সৎ পথে আয় করতে যুদ্ধ করছেন অন্যদিকে লুটপাট করে যাঁরা টাকা বিদেশে পাঠিয়েছেন, তাঁরা সামান্য কিছু কর দিয়ে টাকা ফিরিয়ে আনবেন। দেখা যাবে চোরেরা হয়ে যাবেন শ্রেষ্ঠ করদাতা।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি প্রশ্ন রাখেন, ব্যাংক ডাকাতি করে টাকা বিদেশে নিয়ে গেলে কী হবে? ডাকাতির মামলা হবে না? দুর্নীতি করে টাকা পাচার করলে মামলা হবে না? যদি কারও বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকে, এ সময় তিনি যদি টাকা ফিরিয়ে আনেন, তাহলে কি মামলা চলবে না? তিনি বলেন, এমন একটি বিধান রাখা উচিত, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে এই সুযোগটি নেওয়া যাবে না।
জাতীয় পার্টির এই সদস্য বলেন, ভারতেও এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে আশানুরূপ সফলতা আসেনি।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, চলতি অর্থবছরে সরকার অনুমোদিত বাজেটের চেয়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদের আগাম অনুমতি নেওয়া হয়নি। সব টাকা যদি সরকারই ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে জনগণ কী নেবে? এ কারণেই অনেক উন্নয়ন হলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।
পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা যায় কি না, তা দেখার আহ্বান জানান সরকারি দলের সদস্য প্রাণ গোপাল দত্ত। তিনি বলেন, সমাজে এটার ইতিবাচক প্রভাব নেই। যাঁরা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, তাঁরা যদি সৎ হতেন তাহলে টাকা দেশেই রাখতেন। চোর ধর্মের কথা শোনে না, এটা মাথায় রাখা উচিত।
একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এক ডজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। তিনি বলেন, এটি করা হলে এক দিনে দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমে যাবে। এটি করার পরও যদি দুর্নীতি না কমে, তাহলে তিনি সংসদ থেকে ইস্তফা দেবেন।
মোকাব্বির খান বলেন, দুর্নীতিবাজেরা সিন্ডিকেট করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা ডাকাতি করেছে। মানুষের পকেট কেটেছে। ক্লার্ক, ড্রাইভারের মতো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁরা বড় পদে, হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেন, তাঁদের লোম স্পর্শ করার সাহস নেই।
সরকারি দলের সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ‘এক্সপোর্টেড’। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এটি হয়েছে। মানুষের চাহিদা সীমিত না করে সহায়তা বাড়াতে হবে এবং মুদ্রানীতি সহজ করতে হবে।
অন্যদের মধ্যে সরকারি দলের সংসদ সদস্য আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মহিউদ্দীন খান আলমগীর আলোচনায় অংশ নেন।