ভয়াবহ বন্যায় মাত্র দুই দিনে ৪০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। দেশের ছোট-বড় ১০৯ নদ-নদীর ৯৫টিতেই পানি বেড়েছে। এর মধ্যে ১১ নদ-নদীর ১৭ পয়েন্টে বন্যার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের আরও ১৭ জেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হতে পারে। গতকালের বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনাও ডুবতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বন্ধ করে দেওয়া হয় সিলেট রেলস্টেশনসহ নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেল যোগাযোগ। এসব অঞ্চলের ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, দেশের ১০ জেলার ৬৪ উপজেলা বন্যাকবলিত। এর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ক্রমাগত বৃষ্টিতে ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নেমে আসা পানি বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা না পাওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। গতকাল সিলেট ও সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনাও ডুবতে শুরু করেছে। এ ছাড়া লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সিলেট, সুনাগমঞ্জে আজও বৃষ্টি হবে। ফলে এসব এলাকার বন্যার পানি আরও বাড়তে পারে। উত্তরাঞ্চলের আরও কিছু জেলা প্লাবিত হতে পারে। বন্যার পানি নিচের দিকে নেমে এলে মধ্যাঞ্চলের কিছু জেলাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলে জামালপুর, বগুড়া, শেরপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পাবনায় বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। পানি নিচের দিকে নেমে এলে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ইত্যাদি এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’ উল্লেখ্য, এরই মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বিস্তৃত অঞ্চল বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অবিরাম বর্ষণে দুই রাজ্যের বহু স্থানে দেখা দিয়েছে ভূমিধস।
বন্যার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, আগামী ১২ ঘণ্টায় তিস্তার পানি সমতলে বিপৎসীমার কাছাকাছি অথবা ওপরে অবস্থান করতে পারে। এ সময় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, দুধকুমার, সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, খোয়াই, পুরাতন সুরমা, সোমেশ্বরী ও কংস নদের ১৭ পয়েন্টের পানি এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে দুই পয়েন্টের পানি। পুরাতন সুরমার দেরাই ও কংসের জারিয়াঞ্জাইল পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের বিষয়ে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণবাগে, ২২৬ মিলিমিটার। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও ভৈরববাজারে ১৭৫ মিলিমিটার, সিলেটের জকিগঞ্জে ১৫০ ও মনু রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে ১৪৫, সিলেট পয়েন্টে ১৪৩, হবিগঞ্জে ১৪৮ ও সিলেটের শেরপুরে ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে ভারতের আগরতলায় সর্বোচ্চ ১৬৫ মিলিমিটার, চেরাপুঞ্জিতে ১২০ ও ত্রিপুরার কৈলাশহরে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও খবর-
সিলেট : গতকালও মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নদীতে পানি কেবলই বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এদিকে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত কুমারগাঁওস্থ বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্রটি সচল রাখা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিতরে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে গ্রিডলাইন। ফলে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে পুরো সিলেট জেলা অন্ধকারে থাকে। বিকাল ৬টায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এদিন সকাল থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধারকাজে নামেন। সকালে নৌবাহিনীর ৩৫ জন সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেন। উদ্ধারকাজে তারা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানান, নৌবাহিনীর আরও ৬০ সদস্যের একটি দল সিলেট এসে পৌঁছানোর কথা। আরও দুটি ক্রুজও উদ্ধারকাজে যোগ দেবে। এর মধ্যে একটি সিলেটে ও অন্যটি সুনামগঞ্জে উদ্ধারকাজে যুক্ত হবে।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় নগরের উঁচু এলাকার বাড়িঘর ও দোকানপাটেও পানি ঢুকে পড়ে। দুপুর ১২টার দিকে পানি কিছুটা নামলেও সুরমা তীরবর্তী নগরের এলাকাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। জানা গেছে, নতুন করে নগরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেককে যোগাযোগের জন্য প্লাস্টিকের নৌকা কিনে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সুরমায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় যেসব বাসাবাড়ির নিচ পর্যন্ত পানি চলে গেছে তারাও রয়েছেন আতঙ্কের মধ্যে। রাতের মধ্যে বাসার ভিতর পানি উঠে যাওয়ার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সিলেট রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম গতকাল জানান, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলস্টেশন আপাতত বন্ধ থাকবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে এখন সরাসরি সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবে না। সকালে সিলেট স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ‘কালনী এক্সপ্রেস’ ও ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’ ট্রেন ছেড়ে গেছে। সিলেটের স্টেশন ম্যানেজার আরও বলেন, এখন ট্রেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশন থেকে সম্ভবত চলাচল করবে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলবে। এদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় বৃহস্পতিবার থেকে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক রয়েছে। ফলে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। জানা গেছে, বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আলমাছ উদ্দিন (৩০) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আলমাছ উপজেলার নয়াঠাকুরেরমাটি গ্রামের নাজির উদ্দিনের ছেলে। পুলিশ ও নিহতের পরিবার জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্যার পানিতে বাড়ির পাশের এলাকায় মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন আলমাছ। তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। শুক্রবার দুপুরে নয়াগ্রামে বন্যার পানিতে তার লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লাশ উদ্ধার করে।
সুনামগঞ্জ : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে দুই দিন ধরে বন্যা চলছে। তলিয়ে গেছে জেলার সবকটি উপজেলা। ফলে পানিবন্দি ৪ লাখের বেশি মানুষ। এরই মধ্যে পুরো সুনামগঞ্জ শহর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার মতো সুযোগও নেই শহরবাসীর। ফলে পানিবন্দি অবস্থায় না খেয়েই দিন পার করছে লাখো মানুষ। অনেকে ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন। দুই দিন ধরে পুরো সুনামগঞ্জ শহর বিদ্যুৎবিহীন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বন্যার্ত মানুষের মধ্যে আমরা সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর একটি টিম বন্যাকবলিতদের উদ্ধার ও খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে টোলফ্রি নম্বর চালু করেছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : শুক্রবারের ভারী বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে আখাউড়ায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে দুটি ইউনিয়নের অন্তত আট গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল ভোরে আখাউড়ার সীমান্তবর্তী মনিয়ন্দ ইউনিয়নের কর্নেল বাজারসংলগ্ন আইড়ল এলাকায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙেছে বলে নিশ্চিত করেন মনিয়ন্দ ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চৌধুরী দীপক। তিনি জানান, পানির প্রবল তোড়ে বাঁধসংলগ্ন পিচঢালাই সড়কও ভেসে গেছে। পাশের মোগড়া ইউনিয়নের নিলাখাদ গ্রামসহ মনিয়ন্দ ইউনিয়নের আইড়ল, ইটনা, খারকুট, বড় লৌহঘর, ছোট লৌহঘর ও বড় গাঙ্গাইল গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বগুড়া : সারিয়াকান্দি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। শুক্রবার রাতে যমুনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে গতকাল সকালে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী এলাকার বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানান, যমুনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা নানাবিধ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া উপজেলার বেশ কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
রাজবাড়ী : রাজবাড়ীর পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে পদ্মায় তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়ায় ৩ কিলোমিটার যানবাহনের সারি সৃষ্টি হয়েছে। ছয় থেকে আট ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরি নাগাল পাচ্ছেন যানবাহন চালকরা। বৈরী আবহাওয়ার কারণে তাদের ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি হুহু করে বাড়ছে। গতকাল দুপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ২২ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বানভাসি এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গোখাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট। উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যান সূত্রে জানা যায়, গত দুই দিনে অস্বাভাবিকভাবে সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার নয় উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের ১৪০ গ্রামের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। সেই সঙ্গে তীব্র ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৬০টি বাড়ি।
এদিকে, রৌমারী, চররাজীবপুর, উলিপুর ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই মারাত্মক অবনতি ঘটছে। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ এখন অনেক। বানের পানির কারণে জেলার প্রায় ৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে। নদী ভাঙন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বানভাসি মানুষ রয়েছে চরম দুর্ভোগে। এদিকে তীব্র পানির স্রোতে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মুড়িয়ারহাট এলাকায় অস্থায়ী বেড়িবাঁধের ২১ ফুট ভেঙে মেইনল্যান্ডের ফসল নিমজ্জিত হয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, বাজার, গোয়ালঘর, ধানের গোলাঘরসহ বিভিন্ন জায়গায় পানি উঠেছে। এরই মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উঠতে শুরু করেছেন মানুষ। ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাফিসা আক্তার জানান, ইটনা উপজেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আক্রান্ত এলাকার লোকজন ইটনা সদরে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সরকারি কলেজসহ অন্যান্য আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। তিনি আরও বলেন, গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্লাবিত এলাকাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জামালপুর : যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুরে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে আগাম বন্যা। কয়েক দিন ধরে টানা বর্ষণ আর উজানের নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরামসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় এখনো ঘরে পানি প্রবেশ না করলেও চারদিকে পানি প্রবেশ করায় তারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
লালমনিরহাট : অবনতি হয়েছে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন জেলার ৫ উপজেলার ৩০ হাজার বানভাসি মানুষ। কিছু বানভাসি মানুষ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও আসবাবপত্র নিয়ে সরকারি রাস্তা, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে অধিকাংশই বাড়িতে পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন।
নেত্রকোনা : ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি। জেলার কলমাকান্দা উপজেলার সঙ্গে জেলা সদর এবং অন্যান্য উপজেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। ভেসে যাওয়া বাড়িঘরের মানুষ ছুটছেন নেত্রকোনা ময়মনসিংহের দিকে। সন্তানাদিসহ হেঁটেই পারি দিচ্ছেন বন্ধুর পথ। অন্যদিকে ঢলে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার অতিথপুর, ইসলামপুর এলাকার ৩৪ নম্বর রেলব্রিজটি ভেঙে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে সকাল থেকে। এ ছাড়াও দুর্গাপুর, বারহাট্টা আটপাড়াসহ মোট ৬টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।
নেত্রকোনা রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার নাজমুল হক খান গতকাল দুপুরে বলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টি ও ঢলের পানি বেড়ে নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেললাইনের কিছু অংশ ডুবে গেছে। এ কারণে সকালের আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বারহাট্টা উপজেলার অতীতপুর স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ উপজেলার বিরামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশের রেললাইন এখন পানির নিচে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে নদী ও হাওরের পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে জেলার নিম্নাঞ্চল। জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে পৌর শহরগুলোতে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রধান তিনটি নদীতেই ক্রমান্বয়ে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কের কিছু অংশ। বিশেষ করে হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি হাওরের নিম্নাঞ্চলের গ্রাম।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুরের চরাঞ্চলের ফসলি জমিসহ বসতভিটা তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষ ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।
শেরপুর : শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে বানের পানিতে নিখোঁজ দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত শুক্রবার বিকালে ওই দুজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর গতকাল সকাল ৬টার দিকে পৃথক স্থান থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন- ঝিনাইগাতী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বৈরাগীপাড়া গ্রামের মৃত নফজউদ্দিনের ছেলে কৃষক আশরাফ আলী (৬০) ও ধানশাইল ইউনিয়নের বাগেরভিটা গ্রামের শেখ কাদের আলীর ছেলে রাজমিস্ত্রি আবুল কালাম (৩৩)। অন্যদিকে সদর ইউনিয়নের খইলকুড়া গ্রামের ১২ বছরের এক শিশু ঢলের পানিতে খেলতে গিয়ে ভেসে গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওই শিশুকে পাওয়া যায়নি।
রংপুর : রংপুর অঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে নদীগুলোর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরে। কিছু এলাকায় পানি কমলেও দেখা দিয়েছে ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে দুপুর থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদীতে পানি বাড়তে থাকে এবং চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়। এতে এ তিন উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, বিকাল ৩টায় পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তা নদীর পাশাপাশি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে জেলার অন্য নদীর পানি। যমুনেশ্বরী নদীর পানি বদরগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদী ইসলামপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এদিকে রংপুরের পাশের জেলার নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টায় কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
রাজশাহী : বাড়ছে পদ্মার পানিও। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার রাজশাহী সীমান্তে পানি বেড়েছে দশমিক ১৪ মিটার। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় এ মাসের সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৪ মিটার পানি রেকর্ড করা হয়েছে। এ মাসের প্রথম দিন ১ জুন ছিল ৯ দশমিক ৭৮ মিটার। এখন বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। সামনের দিনে পানি আরও বাড়বে। তবে রাজশাহীতে বন্যার মতো দুর্যোগের এখনো কোনো পূর্বাভাস নেই।
দিনাজপুর : দিনাজপুরের ছোট-বড় সব নদীতেই পানি বাড়ছে। অবিরাম বৃষ্টিপাত হলে জেলার তিন নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল সকালে জেলার আত্রাই, পুনর্ভবা ও ছোট যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করলেও দুপুরের পর তা কিছুটা নেমে আসে। তবে দিনাজপুরে ছোট-বড় ১৯টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার আগামী ৭২ ঘণ্টায় জেলায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
হবিগঞ্জ : পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের ৩টি উপজেলার কিছু অংশ প্লাবিত হয়েছে। অব্যাহতভাবে বাড়ছে কালনী, কুশিয়ারা নদীর পানি। কুশিয়ারা নদীতে শেরপুর পয়েন্টে এরই মধ্যেই বিপৎসীমার ৮ মিটার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বালুর বস্তা নিয়ে নদীর বাঁধ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যে কোনো সময় বাঁধ ভাঙতে পারে এবং বাঁধ ভাঙলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছে তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (অ.দা.) মিনহাজ আহমেদ শোভন জানান, আজমিরীগঞ্জের নিকলী ঢালা বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কাকাইলছেও-সৌলরি সড়ক উপচে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করছে।
বানিয়াচং উপজেলারও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর, রাধাপুর, দিঘলবাগ ও দুর্গাপুর এলাকায় বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করছে। আউশকান্দি ও দিঘলবাগ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর ও রাধাপুরে কুশিয়ারা নদীর বাঁধের ১ ফুট ৬ ইঞ্চি ওপর দিয়ে পানি প্রবেশ করছে।