দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। কারণ এসব এলাকার প্রধান প্রধান নদীর পানি সমতলে বাড়ছে। এসব তথ্যের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরো জানিয়েছে, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
কুড়িগ্রাম: জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনো ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত দেড় লাখ মানুষ। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষ। চুলা জ্বালাতে না পারায় এবং টিউবওয়েল তলিয়ে থাকায় তীব্র হয়ে উঠছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির। অন্যদিকে টানা বৃষ্টি ও উজানের পানিতে গো-খাদ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্য নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিতরা। এসব এলাকার কাঁচাপাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ৯ উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৩৩৮ টন চাল, নগদ ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকার শিশুখাদ্য ও ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যার বিতরণ কার্যক্রম চলমান।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
বগুড়া: জেলায় টানা বৃষ্টির কারণে যমুনা নদীতে আরো এক দফা পানি বেড়েছে। গতকাল দুপুর ৩টায় জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বেড়ে নতুন করে আরো লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ হতে শুরু করেছে পাঠদান।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিনে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮৭টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। ২৩ হাজার ৯০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০০ মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। ৭ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমির ফসল বন্যায় তলিয়ে গেছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে পাঁচ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের সঙ্গে গৃহপালিত প্রাণীও রয়েছে।
বগুড়ার সোনাতলায় বেড়েই চলেছে যমুনা ও বাঙালি নদীর পানি। উভয় নদীর পানিই বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ওঠায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তেকানী চুকাইনগর ও পাকুল্লা ইউনিয়নের ১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় উপজেলার তেকানী চুকাইনগর, পাকুল্লা, জোড়গাছা ও মধুপুর ইউনিয়নের ৫৩২ হেক্টর ফসলের খেত আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে জেলার ধুনট উপজেলায় নতুন করে চরাঞ্চলের পাশাপাশি লোকালয় প্লাবিত হতে শুরু করেছে। পানি বাড়ার কারণে নদী এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।
ফেনী: জেলার ফুলগাজীতে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধে ভাঙনে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। গতকাল উপজেলার ফুলগাজী বাজারসহ অন্তত তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে মাছের ঘের, কৃষকের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। মুহুরী নদীতে ১০৩ সেন্টিমিটার বিপত্সীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানির চাপ অব্যাহত থাকলে নতুন নতুন স্থানে ভাঙন দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্রাফুন নাহার জানান, গতকাল সকাল ৮টার দিকে ফুলগাজীর উত্তর দৌলতপুরে বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এতে করে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়াও উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের বরইয়া গ্রামের একটি স্থানেও বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ দিয়ে প্রতিরক্ষা তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সকাল ৭টার দিকে রেকর্ডে দেখা যায়, মুহুরী নদীর পানি বিপত্সীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির চাপ না কমলে নতুন নতুন স্থানে ভাঙন দেখা দিতে পারে।
রাজবাড়ী: দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌ-রুট রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় তীব্র স্রোতে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দৌলতদিয়া ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড় পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার ও পণ্যবাহী ট্রাকের সারি তৈরি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড গোয়ালন্দ উপজেলার পানি পরিমাপক ইদ্রিস আলী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে নদীতে প্রচণ্ড স্রোত তৈরি হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) প্রফুল্ল চৌহান জানান, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রোতে ফেরির ট্রিপ কমে গেছে, যে কারণে ঘাটে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।