শুধু আফ্রিকা নয়, আমেরিকা-ইউরোপ-এশিয়া বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি, খাদ্যসংকট ও জ্বালানিসংকটের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জনগণের জীবনযাত্রায় যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন খরচের খাতা যেন ক্রমেই বাড়ছে। ‘এ বছর পরিস্থিতি অনেক কঠিন হবে, আগামী বছর তা আরো খারাপ হবে। ’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এমন হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্রমেই অন্ধকার হচ্ছে।
ফলে বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে, যা আগামী ১২ মাসের মধ্যেই হতে পারে। ’
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোক্তা পণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে তা কোটি কোটি মানুষের জন্য জীবনযাত্রাকে সংকটে ফেলেছে। মূল্যস্ফীতি এখন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৪০ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে। গত জুনে যা ৯.১ শতাংশে উঠেছে। ’
এর আগে বিশ্বব্যাংকও মন্দার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মলপাস বলেন, ‘অনেক দেশের জন্য মন্দা এড়ানো কঠিন হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থবির করেছে। এ কারণে ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের শূন্য কভিড নীতি, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও স্টেগফ্ল্যাশনের (উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মন্থর প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্ব) ঝুঁকি বিশ্ব প্রবৃদ্ধিকে বিক্ষত করছে। ’
করপোরেট দুনিয়ায় উদ্বেগ
বিশ্বজুড়ে একটি মন্দার আশঙ্কা করছেন করপোরেট বিশ্বের শীর্ষ ব্যক্তিরাও। তাঁরা বলছেন, যদি খুব বেশি দেরি হয় তবে আগামী বছরের শেষ নাগাদ একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসছে। জ্বালানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের অনিশ্চয়তায় বিশ্ব অর্থনীতি নিম্নমুখী হচ্ছে।
কনফারেন্স বোর্ডের এক জরিপে বৈশ্বিক কম্পানিগুলোর ৬০ শতাংশের বেশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং শীর্ষ ব্যক্তিরা জানান, তাঁরা আশা করছেন আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে একটি মন্দা হানা দেবে। গত মাসে পরিচালিত এ জরিপে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার প্রায় ৪৫০ জন সিইওসহ ৭৫০ জন নির্বাহীর মধ্যে ১৫ শতাংশ জানান, তাঁদের অঞ্চল এরই মধ্যে মন্দায় প্রবেশ করেছে। অর্থনীতির ভাষায়, পর পর দুই প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হলে এটিকে মন্দা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সুদের হার বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। তাই মন্দা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ আরো বেড়েছে। কারণ একই পথ অনুস্মরণ করেছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। চরম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অনেক দেশই সুদের হার বাড়াচ্ছে। এতে ব্যবসায় খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
কম সুদের হারের দিন শেষ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে নিম্ন মূল্যস্ফীতি এবং সুদের হার কমিয়ে রাখার বিষয়টি ইতিহাস হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের শীর্ষ নির্বাহীরা পর্তুগালে বৈঠক করে বলেছেন, পণ্যের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং করোনা অতিমারির কারণে অর্থনীতির মন্দা কত দূর যেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁরা একমত হয়েছেন যে এখন ঝুঁকিটা বড় মনে হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ ঝুঁকি সামলিয়ে ওঠাও কঠিন নয়।
বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে ধাক্কা
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মন্দার শঙ্কায় বিশ্বের বড় বড় পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের এসঅ্যান্ডপি (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর) সূচকের সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে। উল্লেখ্য, লেনদেন হওয়া শীর্ষ ৫০টি কম্পানির সমন্বয়ে এসঅ্যান্ডপি গঠন করা হয়েছে। গত ছয় মাসে এসঅ্যান্ডপি সূচক ২০.৬ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া দেশটির পুঁজিবাজারের অন্যান্য সূচকেরও পতন হয়েছে। নাসডাক, দাও জোনসের শেয়ারের দামও ক্রমাগতভাবে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়ার দেশগুলোর শেয়ারবাজারেরও পতন হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে এফটিএসই-২৫০ সূচকে এ বছর ২০ শতাংশ পতন হয়েছে। ইউরোপের স্টকস-৬০০ সূচকেরও ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ারের দামও পড়েছে ১৮ শতাংশ।
চীনা সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন
শূন্য কভিড নীতি অনুস্মরণ করতে গিয়ে বড় শহরগুলোতে লকডাউন দিচ্ছে চীন। এতে বিশ্বে বড় কম্পানিগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ কার্যক্রম দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, যা ইউরোপসহ সারা বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
জাপানের দাই ইচি লাইফ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়োশিকি শিনকে বলেন, ‘পৃথিবীব্যাপী কারখানাগুলোতে চীনা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় ব্যাপক হারে। চলতি বছরের বেশির ভাগ সময় দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে কঠোর লকডাউন থাকার কারণে সেখানকার কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকে। এতে বিভিন্ন দেশের কারখানার উৎপাদনে টান পড়ে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও পুরোপুরি উৎপাদনে ফেরেনি কারখানাগুলো। এতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। ’
ইউরোপের জ্বালানি আতঙ্ক
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের ১০টি দেশে পরিচালিত হয় একটি জরিপ, যা গত জুনে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ইউরোপীয় চায় যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত। কেননা এই যুদ্ধ তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস ও ২৬ শতাংশ জ্বালানি তেল আসে রাশিয়া থেকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় দেশগুলোর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা স্বয়ং ইউরোপীয়দেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আসছে শীতে বাড়িঘর উষ্ণ রাখতে তাদের গ্যাস দরকার। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়ানরা প্রায় সমান ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তাদের একটি অংশের দাবি, এখনই ব্যয় ও খরচ কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। অন্য অংশটি বলছে, তারা ন্যায়বিচার চায়। সূত্র : ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজ, ফিন্যানশিয়াল টাইমস, গার্ডিয়ান