ফাহিমা আক্তার সুমি
আদিবা সুলতানা নিশি। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে কিনেন স্মার্ট ফোন। গত বছরের শেষদিকে বন্ধুদের সহযোগিতায় অ্যাপসের মাধ্যমে একটি টিকটক আইডি খোলেন। শুরুতে এই আইডি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। অন্যদের আইডির ভিডিও দেখে তার আইডিতে নিজের একটি ফানি ভিডিও আপলোড করেন। এরপর তার আইডিতে যুক্ত হতে থাকেন অনেকে। অন্যদের করা ভিডিও দেখে তিনিও শুরু করেন নিয়মিত ভিডিও তৈরির কাজ। নিজের আইডিতে ছাড়তে থাকেন একটার পর একটা ভিডিও। পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে বাসা অথবা বাইরে যেখানেই ঘুরতে যান সেখানেই ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করেন ভিডিও। ধীরে ধীরে টিকটকের প্রতি আসক্ত হয়ে যান।
টিকটক অ্যাপস ব্যবহার করার পর পড়াশোনায় হারিয়ে ফেলেন আগ্রহ। নিশি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শুরু থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল তার। কিন্তু এইবার সেমিস্টার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও আগের চেয়ে ফলাফল খারাপ হয়। পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। এখন টিকটক ছাড়তে চাইলেও এই আসক্তি থেকে সহজে বের হতে পারছেন না। শুধু নিশি না এমন অনেকে এখন এই আসক্তিতে জড়াচ্ছেন। ঘটছে নানা অঘটন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকটক ব্যবহারে সমাজে একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি অসুস্থ বিনোদন প্রক্রিয়া। ফলে ঘটছে পাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, সংসার ভাঙাসহ বিভিন্ন অপরাধ। এটি সামাজিক বিষফোঁড়া ছাড়া আর কিছু নয়। টিকটকের মাধ্যমে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এটি আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তারা মাদকের নেশার মতো টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যবহারকারীরা যেমন আসক্ত হচ্ছে তেমনিভাবে যারা উপভোগ করছেন তাদেরও এর প্রতি আসক্তি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে এই বিকৃত রুচিহীন ভিডিও দেখার প্রভাবে শিশুরাও রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। নিশি বলেন, আমি অনেকটা এলোমেলো জীবন-যাপন করছি। সবসময় চিন্তা হয় কখন একটা ভিডিও তৈরি করে আমার টিকটক আইডিতে ছাড়বো। এটা একটি নেশার মতো। অন্যদের ভিডিওর সঙ্গে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। টিকটক ব্যবহারের পরে আমার রেজাল্টও অনেক খারাপ হয়েছে। সবকিছু ছেড়ে এই ভিডিও তৈরিতে সময় চলে যাচ্ছে। এখন না পারছি পড়াশোনা ঠিকমতো করতে না পারছি টিকটক ছাড়তে। ভাইরাল হতে অনেক সময় ঝুঁকি নিয়েও ভিডিও তৈরি করার চিন্তা মাথায় আসে। শুধু নিশি নন, এমন অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ টিকটক ভিডিও তৈরিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। দিন দিন বাড়ছে এই অ্যাপস ব্যবহারকারীর সংখ্যা। টিকটকের প্রতিযোগিতামূলক ভিডিও তৈরির মাধ্যমে রাতারাতি স্টার হতে চান অনেকে।
সস্তা উন্মাদনাভিত্তিক বিনোদনের প্রতি শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের দেখার আগ্রহও বাড়ছে। ব্যবহারকারীরা ছবির ক্লিপিংয়ের সঙ্গে অভিনয় করে নিজের ব্যক্তিগত ভিডিও ও চেহারা বিকৃত করে ভিডিও তৈরি করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে ঝুঁকি নিয়ে ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যুও ঘটেছে। সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম বা চর্চা না থাকায় এই ধরনের প্রযুক্তি কেন্দ্রিক অসুস্থ বিনোদনের জায়গা তৈরি হচ্ছে। অসুস্থ কিংবা নীতি নৈতিকতা, সংস্কৃতি বিরোধী ও শিষ্টাচার বহির্ভূত এই ধরনের বিনোদনে মেতে উঠেছে মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে। নারী পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি তাদের পাচার করে ভারতের পতিতালয়ে বিক্রিও করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, প্রযুক্তির প্রসার বন্ধ করা মুশকিল। এই বিপর্যয় এখনো না থামালে বড় ধরনের একটি সামাজিক অসুখে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে আচারণগত বিকৃতিপণা তৈরি হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনাও বাড়বে। নারীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তৈরি হবে ও বিকৃত যৌনপণা বাড়বে। পড়াশোনা থেকে তরুণ সমাজ দূরে সরে যাবে। তাদের নৈতিক এবং গঠনমূলক ব্যক্তিত্ব তৈরিতে বাধা সৃষ্টি হবে। বন্ধন এবং পারস্পরিক সহনশীলতা তৈরি হবে না। এর মাধ্যমে বুদ্ধিভিত্তিক ভাবে বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরি দিকে নিয়ে যাচ্ছে। টিকটকের ভিডিওগুলোকে একেবারে অসুস্থ বিনোদন উপকরণ বলা যায়। এটি এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।
তা না হলে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশের মানুষকে হতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র, সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি গুরুত্ব দিয়ে না দেখেন তবে পরিবার বা সমাজের দায় অবশ্যই আছে। পরিবারের একজন সদস্য যখন বিপথে যায় তখন পরিবারের একটি দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। অভিভাবকদের উচিত তার সন্তান কি করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কি দেখছে সেটি খোঁজখবর রাখা। সন্তানদের সঙ্গে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কিংবা তার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট সভা, র্যালি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই প্রযুক্তি কেন্দ্রিক তরুণ বা শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। রাষ্ট্র যখন নীরব ভূমিকা পালন করে তখন কিন্তু সামাজিক, সাংস্কৃতিক অথবা নাগরিকদের দায়িত্ববোধের মাধ্যমেই দেশ বা সমাজ বেঁচে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান মানবজমিনকে বলেন, টিকটক ব্যবহারে প্রচণ্ড রকমের ক্ষতি হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব জিনিসগুলো বেশি পপুলার হয়ে যায় সেখানেই একটা কিছু ঘটতে শুরু করে। তরুণ সমাজ বেশি ইমোশনাল, ফান করতে করতে এসব জিনিসে আসক্ত হয়ে যায়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।
করোনা যেভাবে ছড়াচ্ছে টিকটকও কিন্তু এভাবে ছড়িয়ে গেছে। এটি শুধু তরুণ-তরুণীরা না, মধ্যবয়সী অনেকেই টিকটকের জন্য বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অনেকের সংসার পর্যন্ত ভেঙে যাচ্ছে। ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে বিকৃত ভাষা অবলীলায় বলে ফেলছে সেটি আমাদের কালচারের সঙ্গে একদমই যায় না। ভিডিও তৈরির চ্যালেঞ্জিং বিষয়টা তরুণদের মধ্যে বেশি হয়ে থাকে। আজকে কিশোররা আসক্ত হচ্ছে আগামীতে ছোট শিশুদের মধ্যে এই জিনিসটা চলে আসবে। মারাত্মক ঝুঁকিতে শিশুরাও। শিশুরা এখন ঝুঁকির বর্ডার লাইনে আছে। এটি সমাজে সাংঘাতিক আকারে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নতুন প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে পড়বে। ফান করতে করতে নিজেদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিজেরাও জানে না। টিকটকের মাধ্যমে দেশে সুখকর কিছু হচ্ছে না। বরং সংসার ভাঙা থেকে শুরু করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।