এমপি-নেতা দূরত্বে তৃণমূলে বাড়ছে কোন্দল

এমপি-নেতা দূরত্বে তৃণমূলে বাড়ছে কোন্দল

টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকায় ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক এমপি। তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে তোয়াক্কা করছেন না তারা। এমপি লীগ না হলেই চলে চড়-থাপ্পড়।

সূত্র বলছে, সম্প্রতি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, এমনকি দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে কিল, ঘুসি মেরে, চড়-থাপ্পড় দিয়ে ও পিটিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন বেশ কয়েকজন এমপি। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রভাব, খবরদারি, দলাদলি, তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবহেলা, নির্বাচনি এলাকায় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে।

 

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দলের অভ্যন্তরে বিরোধ সৃষ্টি, টেন্ডার ও বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপের মতো বাড়াবাড়ি করছেন এমপিরা। যারা যতক্ষণ এমপির স্বার্থ হাসিলসহ মন জুগিয়ে চলতে পারবেন, ততক্ষণ তারাই এমপির ডান হাত। তাদের হাতেই থাকে সব কিছু। যেকোনো বিষয়ে তারা যেটি বলেন, সেটিই সিদ্ধান্ত। প্রশাসনও তাদের সমীহ করে চলে। শুধু তাই নয়, এমপি বলয়ে না থাকলে জোটে না উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পদও। এ ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক নৌকা পেলেও এমপির নিজের লোক না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে তার বিজয় নিশ্চিত করেন তারা।

বিশেষ করে গত এক যুগে সরকারদলীয় দলে এমন দুরবস্থা ক্রমেই বাড়ছে। এতে করে আওয়ামী শিবিরে চাপা অসন্তোষ বাড়ছে। কেউ কেউ সাহস করে কথা বলছেন। ফাঁস করে দিচ্ছেন সব গুমের। ফলে এমপিদের হাতে মারধরের শিকার হচ্ছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সরকারি লোকজন। অনেকে আবার কৌশলী। হেনস্থা হওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে চান না।

যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হাইকমাণ্ড একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, কেউ দলীয় মনোনয়ন পেলে তার বিপক্ষে কোনো এমপি, মন্ত্রী বা দলীয় কোনো নেতা কাজ করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি তারা দলীয় কোনো পদ-পদবিতেও থাকতে পারবেন না। তারপরেও যেন থেমে নেই এমপিদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে আঁতাত ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব।

 

সম্প্রতি রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে চড়-থাপ্পড় ও হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে আহত করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলইডি হলে দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে পিটিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এ ছাড়া গত এক বছরে অর্ধডজন এমপি বিভিন্ন জনকে পিটিয়ে নিজেদের সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ  বলেন, রাজশাহী-১ আসনের (গোদাগাড়ী-তানোর) এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই শিক্ষকই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাকে এমপি কোনো মারপিট করেননি। বরং অন্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়েছে, সেটি এমপি সাহেব ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। আর গত শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলইডি হলে দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল মারধর করেছেন বিষয়টি এমন নয়। আমি সেখানে ছিলাম। তাদের দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়েছে। একজন আরেকজনকে বলেছেন, ধাক্কা দিয়েছেন। তবে সেটি নিয়েও আগামী ২১ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতাদের নিয়ে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসবে। দুপক্ষের মতামত শুনব। তবে যে যত বড়ই এমপি, মন্ত্রী বা নেতা হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন  বলেন, আমরা আগামী ২১ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতাদের নিয়ে দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসব। দুপক্ষের অভিযোগ শুনব। তারপরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিএনপি নয়। যে সকালে বহিষ্কার, বিকালে আবার দলে যোগদান। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। তাই সব কিছু গণতান্ত্রিকভাবে হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করব। তারপরেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

 

গত ৭ জুলাই রাজশাহী-১ আসনের (গোদাগাড়ী-তানোর) এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে প্রকাশ্যে কিল-ঘুসি ও হকিস্টিক দিয়ে পেটানোর অভিযোগ ওঠে। সরকারি কর্মকর্তা, দলীয় নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ পিটিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন। মানুষ পেটানোয় সিদ্ধহস্ত এই সংসদ সদস্য গত ২১ মে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা বাজারসংলগ্ন স্লুইসঘাট এলাকায় সালিশি বৈঠক ডেকে এক মাছ ব্যবসায়ীকে চড়-থাপ্পড় মারেন। ফোরকান মিয়া নামের ওই মাছ ব্যবসায়ী বাকিতে সিগারেট না পেয়ে মারধর করেছিলেন এক দোকানিকে। এ ঘটনায় নালিশ পেয়ে সালিশ ডাকেন এমপি রিমন। এরপর শাস্তি হিসেবে নিজেই চড়-থাপ্পড় দেন অভিযুক্ত ফোরকানকে।

ফোরকানের অভিযোগ, তিনি বরগুনার সংরক্ষিত (নারী) আসনের এমপি সুলতানা নাদিরার সমর্থক। নাদিরার সমর্থক হওয়ার কারণেই তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মেরেছেন এমপি রিমন। এমপি নাদিরার বাড়িও পাথরঘাটায়। গত ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংসদ সদস্যের মোটরসাইকেল বহরকে সাইড না দেওয়ায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মাছ ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলামকে বেধড়ক মারধর করেন একই এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন। নির্যাতনের শিকার মাছ ব্যবসায়ী নজরুল ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বিএফডিসি মৎস্য পাইকার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক। এর আগেও সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল এমপি রিমনের বিরুদ্ধে।

গত ১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও গণিতের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনকে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক দলিল লেখককে ঢাকা-৫ আসনের এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মারধর করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগ অনুযায়ী, চেয়ার দিয়ে মারধর করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মাথা লক্ষ্য করে পানির গ্লাস ছুঁড়ে মারেন সংসদ সদস্য। গালাগালের পাশাপাশি হত্যার হুমকিও দেন তিনি। ভুক্তভোগী দলিল লেখকের নাম আনোয়ার হোসেন। বর্তমান এমপিদের পাশাপাশি থেমে নেই সাবেক এমপিরাও। নানা আলোচনা-সমালোচনায় থাকা কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি টেকনাফে দলের বর্ধিত সভায় তিন নেতাকে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন।

 

মারধরের শিকার নেতারা হলেন- টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইউছুফ মনো, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ইউছুফ ভুট্টো ও উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক। নেতাদের পেটানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, বদির সঙ্গে তার ভাই আবদুস শুক্কুর ও কয়েকজন নেতা মিলে তাদের পেটাচ্ছেন। এতে দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে গাজীপুর-৪ আসনের এমপি সিমিন হোসেন রিমির বিরুদ্ধেও। রিমিকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খান। তিনি  বলেন, পারলে এমপি সিমিন হোসেন রিমি আমাকে গলাটিপে মেরে ফেলেন। আমাকে তিনি কোনো কাজ করতে দেন না। ২৪ ঘণ্টা আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করেন। আমার অফিসারদের কোনো কাজ করতে দেন না। তারপরেও মেনে নিয়ে কাজ করছি।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা। তাই তিনি কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহে এখনও টিকে আছি। এক ধরনের বাঘে-মহিষে লড়াইয়ের মতো টিকে আছি।

রোববার সচিবালয়ে রাজশাহীতে একজন কলেজ অধ্যক্ষকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) মারধর এবং পরবর্তী সময়ে তাকে চাপ দিয়ে অস্বীকার করানোর বিষয়ে বিব্রত শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, এই ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট পেলে জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে তার বিচার দিতে চাই। এ সময় শিক্ষামন্ত্রীর পাশে বসা ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এ ছাড়াও ছিলেন মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব এবং কর্মকর্তারা।

দীপু মনি বলেন, এখানে দুজন জনপ্রতিনিধি আছি, আমাদের জন্য নিশ্চয়ই খুব বিব্রতকর। এই অভিযোগগুলো উত্থাপন হওয়া খুব বিব্রতকর। আর সেগুলো যদি সত্য হয়, সত্য প্রমাণিত হয় সেগুলো আরও বিব্রতকর। তবে যদি কোনো সংসদ সদস্য এ ধরনের কাজে যুক্ত থাকেন সে ক্ষেত্রে সেই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আমরা মন্ত্রণালয় হিসেবে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। যেটি আমরা করতে পারি, সেটি হলো আমরা স্পিকারের শরণাপন্ন হতে পারি। তার মাধ্যমে অভিযোগ উত্থাপন করে এর একটি সমাধান চাইতে পারি। আমরা তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরে প্রয়োজনে সেই পথ অনুসরণ করব। এ সম্পর্কে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

রাজনীতি