বৈশ্বিক পটপরিবর্তনে দেশে কমছে গমের দাম

বৈশ্বিক পটপরিবর্তনে দেশে কমছে গমের দাম

খাদ্যশস্য রফতানিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশ্ববাজারে একদিনেই কমেছে গমের বাজার। তাছাড়া ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যশস্য ও সার আমদানিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। একই সময়ে রাশিয়ার সাতটি ব্যাংকের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকা বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্যের বাজার অবশেষে নিম্নগামী হয়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে স্থিতিশীলতা ফেরার খবরে কমছে দেশের বাজারও। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে গমের দাম কমেছে মণপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ভারতীয় গম সরবরাহ আদেশ (এসও) পর্যায়ে ১ হাজার ৫২০ টাকা ও পাইকারিতে ১ হাজার ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও পণ্যটির দাম ছিল মণপ্রতি ১ হাজার ৬০০ টাকা। অন্যদিকে কানাডিয়ান গম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ২ হাজার ১০০ (এসও) টাকা, পাইকারিতে ২ হাজার ১২০ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও একই মানের গমের দাম ছিল মণপ্রতি ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২২০ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে গমের দাম কমেছে মণপ্রতি ২০-৩০ টাকা।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাস আগেও দেশে প্রতি মণ গমের দাম ছিল মানভেদে ৯৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হলে গমের দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ অর্থাৎ মণপ্রতি ২ হাজার ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশে আটা ও গমের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্যশস্য হিসেবে চালের পর দেশে গমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গমের দাম কমতে থাকায় শিগগিরই আটা ও ময়দার দাম কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

আমদানিকারকরা বলছেন, খাদ্যশস্য রফতানিতে সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি করায় এখন কম দামে গমসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানি করা যাবে। চুক্তির ফলে বিশ্ব কমোডিটি মার্কেট নিম্নমুখী হওয়ায় বাংলাদেশ রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি না করলেও এর সুফল পাবে। তাছাড়া সরাসরি আমদানি না করলেও তৃতীয় কোনো দেশ বা ওইসব দেশের এজেন্সির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারবে। বর্তমানে মধ্য ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের গমের উত্তোলন মৌসুম শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক মাসে কানাডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশের উত্তোলন মৌসুম শুরু হবে। যার কারণে আসন্ন মৌসুমটি বৈশ্বিক খাদ্যশস্যের বাজার নিম্নগামী অবস্থায় স্থিতিশীল থাকবে। এতে শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পণ্যবাজার আরো নিম্নমুখী হবে বলে আশা করছেন তারা।

জানতে চাইলে দেশে শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জভিত্তিক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ইউক্রেনে ক্রমণ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা আরোপে খাদ্যশস্যের বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ও রাশিয়ার বড় অংশগ্রহণ থাকায় দুনিয়াজুড়ে সংকট তৈরি করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে দেশীয় বাজারে ডলারের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ বেশি থাকায় এর শতভাগ সুবিধা বাংলাদেশ না পেলেও ধীরে হলেও দেশের পণ্যবাজারের দামের ঊর্ধ্বমুখিতা নিম্নমুখী হবে বলে মনে করছেন তিনি।

তিনি আরো জানান, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মানে হলো ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ইউক্রেনের প্রধান বন্দর রাশিয়ার দখলে থাকায় ইউরোপের বড় শস্যক্ষেত্রটি গোটা বিশ্বের কাছ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে বিকল্প বেশকিছু দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গমের বৈশ্বিক বাজার সাম্প্রতিক সময়ে ১০ শতাংশ কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ডলার মূল্যহার ১৮-২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমার প্রভাব পড়ছে কম। এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমলে সার্বিকভাবে সংকট কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।

কাস্টমসের তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪০ লাখ টন গম। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টন গম।

খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গমের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেনের চুক্তি, আন্তর্জাতিক বুকিং কমতে থাকায় দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। সর্বশেষ কয়েক দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম মণপ্রতি অন্তত ৫০ টাকা কমেছে। ইউরোপের গমের সরবরাহ বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক হয়ে এলে দাম আরো কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি।

নাসডাক ডটকমের তথ্যমতে, ৫২ সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববাজারে গমের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল টনপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৯৪ ডলার এবং সর্বনিম্ন দাম ছিল ৬৭৫ দশমিক ৫ ডলার। শুক্রবার পণ্যটির বুকিং দর টনপ্রতি ৮০৬ ডলারে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ৭৫৯ ডলারে স্থির হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ৭ মার্চ গমের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৯৪ ডলারে গিয়ে ঠেকে। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গমের দাম ১৭ মে ১ হাজার ২৭৭ ডলার, ২৩ মে ১ হাজার ১৯০, ২৭ মে ১ হাজার ৯৫৭, ১৬ জুন ১ হাজার ৯০, ২২ জুন ৯৮৮, ২৮ জুন ৯৩৬, ৮ জুলাই ৮৯১, ১২ জুলাই ৮১৪ ডলারে নেমে আসে। কয়েক দিনের মধ্যে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে গমের বুকিং দাম ৮০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

Others