ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বাসিন্দা মো. কবির হোসেন। তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। তিনি চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে ঢাকার কিডনি হাসপাতালে আসেন। সেখানে আবদুল মান্নান নামে এক দালালের খপ্পরে পড়েন। ওই দালাল কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ২৫ লাখ টাকা দাবি করেন। রাজি হয়ে যান কবির। দালাল মান্নান ডোনার জোগাড় করেন। এরপর কবির, তার ভাই মো. সগীর হোসেন ও ডোনার আহমেদ শরীফকে বিমানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের দিল্লিতে। সেখানে দালাল মাসুদ রানা তাদের রিসিভ করেন।
এই দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তিনি ১৯ লাখ ১১ হাজার টাকা খুইয়েছেন। চিকিৎসার অভাবে ভারতেই মারা যান কবির। দালাল চক্র পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে চার মাস জেল খাটেন কবিরের ভাই সগীর। পরে কলকাতা হয়ে লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে দেশে আসেন সগীর। ২০২১ সালের ২৪ মে কবিরের ভাই মো. জাকির হোসেন বাদী হয়ে এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গ্রেফতার হন দালাল আবদুুল মান্নান ও মাসুদ রানা। কবিরের পরিবার বলছে, টাকা নয়, ভয়ংকর দালাল চক্রের বিচার চাই।
নিহত কবিরের ভাই সগীর বলেন, মো. কবির হোসেন তার পরিবার নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার বড়ইতলা শুভ্যাঢা এলাকার চরকালিগঞ্জে থাকতেন। সেখানে তিনি তাকওয়া ফার্মেসি নামে একটি ওষুদের দোকান পরিচালনা করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া থানার মাহিষকান্দিতে। মহামারি করোনার শুরুতে ২০২০ সালে মার্চে কবির ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। কাঁঠালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
কিন্তু কবিরের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বরিশালের আবদুুল্লাহ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কবিরের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তারা ডায়ালাইসিস করার পরামর্শ দেন। সেখানে প্রথম ডায়ালাইসিস করা হয়। এরপর ২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকার জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি হাসপাতালে আনা হয়। সেখানকার সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাহবুব-উল আলম ও ডা. শোহানী কবির দেখে দুটি কিডনিই নষ্ট হয়েছে বলে জানান।
এরপর তারা ডায়ালাইসিস করতে নিষেধ করেন। তাদের ওষুধে চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু কবিরের শারীরিক উন্নতি হচ্ছিল না। পরে ওই দুই ডাক্তার কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন এবং দালাল আবদুল মান্নানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মান্নান কিডনি প্রতিস্থাপনে ২৫ লাখ টাকা দাবি করেন। এতে কবিরের পরিবার রাজি হয়ে যায়। আহমেদ শরীফ নামে একজন ডোনার জোগাড় করেন মান্নান। এরপর ল্যাবএইড হাসপাতালে ক্রসম্যাচ করে মিলে গেছে বলেও জানানো হয়। ভারতে অবস্থানরত দালাল মাসুদের সঙ্গে কথা বলে কিডনি প্রতিস্থাপনে ১৯ লাখ টাকায় চুক্তি করেন মান্নান। ১৪ নভেম্বর মান্নান নগদ ৩০ হাজার এবং চেকের মাধ্যমে ৫৩ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। এরপর ২২ ডিসেম্বর কবির, তার ভাই সগীর ও ডোনার আহমেদ শরীফকে বিমানে ভারতের দিল্লি পাঠানো হয়। সেখানে দালাল মাসুদ তাদের রিসিভ করেন। উত্তর প্রদেশের নয়ডা গেস্ট হাউসে নিয়ে কবির ও সগীরের পাসপোর্ট নিয়ে যান মাসুদ। ২৩ ডিসেম্বর দালাল মাসুদ চিকিৎসা বাবদ সগীরের কাছ থেকে ৪ হাজার ডলার নিয়ে যান। ভারতের উত্তর প্রদেশের ফোরটিস হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন মাসুদ, কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেননি। এরপর ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি সগীরের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের গোল্ড কার্ডের মাধ্যমে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা নেন মাসুদ। ১১ জানুয়ারি মাসুদের স্ত্রী সাহিনা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে এমএস মডার্ন ফার্মেসির অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। ১৩ জানুয়ারি এমএস মডার্ন ফার্মেসির অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ঢাকার জিনজিরা থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন মাসুদ।
একই দিন ঢাকা ব্যাংকের আগানগর শাখা থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন মান্নান। এরপর দালাল মাসুদ কিডনি প্রতিস্থাপনের নামে নয়ডা গেস্ট হাউস থেকে ২২ জানুয়ারি কবির ও ডোনার আহমেদ শরীফকে নিয়ে যান। তবে সগীরকে নয়ডা গেস্ট হাউসেই থাকতে বলেন। কিন্তু ২৮ জানুয়ারি কবিরের খোঁজে সগীর বাইরে বের হলে উত্তর প্রদেশের নয়ডা এলাকার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ৬ মে পর্যন্ত জেল খেটে বের হন সগীর। কবিরের খোঁজ না পেয়ে দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা আসেন সগীর। দালাল মাসুদ পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় এ বিপদে পড়েন সগীর। এরপর লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। জানতে পারেন তার ভাই মো. কবির হোসেন ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির সাফদারজং হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে কবিরের লাশ দেশে এনে দাফন করা হয়। আর এ ঘটনায় ২৪ মে নিহত কবিরের ছোট ভাই মো. জাকির হোসেন বাদী হয়ে ডিএমপির পল্টন মডেল থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন- দালাল মাসুদ রানা, তার স্ত্রী সাহিনা, দালাল আবদুল মান্নান, ডোনার আহমেদ শরীফ, তার ভাই কুতুব শরীফ, মিজানুর রহমান, ওয়াজুল হক, শাহিন ওয়াসিম, ইন্ডিয়ান ছালাম ও আইয়ুব আলী। এরপর পুলিশ আসামি মাসুদ রানা ও আবদুল মান্নানকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ তদন্ত করছে। নিহত কবিরের ভাই মো. সগীর হোসেন বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনকারী প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে ১৯ লাখ ১১ হাজার টাকা খুইয়েছি। বিনা চিকিৎসায় ভাই কবিরও মারা গেলেন। আমিও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ভারতে চার মাস জেল খাটলাম। মাসুদ রানা, আবদুল মান্নানকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অন্য আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাই। টাকা ফেরত নয়, মাসুদ, মান্নানসহ দালাল চক্রের বিচার চাই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের এসআই মো. স্বপন মিয়া জানান, কবির নিহতের ঘটনায় মাসুদ রানা ও আবদুল মান্নানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এরা একটি চক্র। এই চক্রে মাসুদ, মান্নান ও আহমেদ শরীফের যোগসাজশ পাওয়া গেছে। অন্যদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।