লেভেল ক্রসিংয়ে বাড়ছে ঝুঁকি

লেভেল ক্রসিংয়ে বাড়ছে ঝুঁকি

সারা দেশে ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথের ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকি ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রক্ষী বা গেইটকিপার আছে। বাকি ৫৩৮টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ে কোনো গেইটকিপার নেই। রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ২৯ জুলাই লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১২ যাত্রী নিহত হয়েছেন। এভাবে লেভেল ক্রসিংয়ের এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল (চলতি মাস পর্যন্ত) অন্তত লেভেল ক্রসিংয়ে ১ হাজার ৩৬২টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৯১ জন প্রাণহারিয়েছে। দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লেভেল ক্রসিং-এর দুর্ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা বলেছেন, রেলপথে গত ৭ সাসে ১ হাজার ৫২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৭৮ জন। ৭ মাসে রেলক্রসিংয়ে ৩৪ টি দুর্ঘটায় প্রাণ হারিয়েছে ৭৪ জন। সবমিলিয়ে ২০১২ সাল থেকে চলতি সময়ে পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৩৬২টি রেল দুর্ঘটনায় ২৯১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ৮২ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত আর ১৮ শতাংশ রেল ক্রসিংই ক্রটি।

এসব দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। তবে এসব দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছে না কেউ। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই রেলওয়ে দায় চাপাচ্ছেন সড়ক বিভাগের ওপর। আবার সড়ক বিভাগ বলছে এর দায়-দায়িত্ব রেলওয়ের। সারা দেশে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৬১টিই অবৈধ রেল ক্রসিং। যার কোনো অনুমোদন নেই (অবৈধ)।

এসব অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে। যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। কোনো কোনো মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কারণে মাঝপথে ঝুলে আছে। ফলে প্রর্যায়ক্রমে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে ঠিকই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে।

এরপরে রয়েছে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা। ফলে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। লেভেল ক্রসিংয়ে রেলরক্ষী না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে এবং এতে ক্ষতি হচ্ছে রেলের সম্পদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

রেলপথে যেকোনো স্থানে অনুমোদন না নিয়েই লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। আর এতে অনেক সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সায়ও রয়েছে। এ নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। আর এসব কারণে সবগুলো লেভেল ক্রসিংয়ে রক্ষী দেওয়া সম্ভব হয়।

রাজধানীতে রেলপথের প্রতি ১ থেকে ২০০ গজ পর পর লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসবের জন্য রেলের কাছ থেকে তারা কোনো অনুমোদন নেয়নি।

জানা গেছে, রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই। এ কারণে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না, যার ফলে গত ৩ বছরে শুধু রাজধানীতেই রেলের দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬০টি। মারা গেছেন ৫০ জনের অধিক। এদিকে সময় বাঁচাতে বর্তমানে রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কিছু ট্রেনের রানিং টাইম কমাতে বাড়ানো হয়েছে গতি। এতে করে অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এসব মিলিয়ে রেলের ওপর থেকে শনিদশা কাটছে না।

জানা গেছে, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডব্লিউআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), এপিডব্লিউআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), মিস্ত্রি, চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন।

প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। তাই দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। পিডব্লিউআই সপ্তাহে একদিন এবং এপিডব্লিউআই সপ্তাহে তিনদিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করার এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াশার, নাট-বোল্টু চেক করার কথা থাকলেও তারা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানায়, চট্টগ্রাম মিরেরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতদের দ্রুত উদ্ধার ও বিনামূল্যে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার দাবি জানান। একই সাথে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান।

এ বিষয়ে ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সারা দেশে যেসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে সেগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটছে। তিনি বলেন, দেখা যাচ্ছে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলোতেও মাত্র ৯৮১ জন গেটম্যান অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন। ফলে সার্বক্ষণিক ডিউটিতে থাকছে না গেটম্যানরা। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ের অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের বাইরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং রয়েছে।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) পূর্বাঞ্চলে ২৩৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫৮টি, ইউনিয়ন পরিষদের পূর্বাঞ্চলে ২৯৮টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২০৪টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭টি, সিটি করপোরেশনের পূর্বাঞ্চলে ২২টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৩২টি, উপজেলা পরিষদের পূর্বাঞ্চলে ৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২টি, পৌরসভার পূর্বাঞ্চলে ৫৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৫৯টি রেল ক্রসিং নির্মাণ করেছে। এর বাইরেই পূর্বাঞ্চলে অন্তত ১০৯টি ও পশ্চিমাঞ্চলে অন্তত ৬১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে।

লেভেল ক্রসিং বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের জানান, রেল নিজস্ব পথে চলে, রেল কখনো সড়কে উঠে না। দিনের পর দিন লেভেল ক্রসিংয়ে সড়ক যান উঠে পড়ছে। দুর্ঘটনায় রেলের ব্যাপক ক্ষতিসহ সাধারণ ট্রেনযাত্রীও নিহত হচ্ছে। লেভেল ক্রসিং বৈধ কিংবা অবৈধ যেটাই হোক দুর্ঘটনা ঘটে, সেজন্য রেল দায়ী নয়। তবুও রেলকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় সড়ক বিভাগেরও রয়েছে বলে তিনি জানান।

জাতীয়