নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে হঠাৎ করেই ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সম্প্রতি কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অতি প্রয়োজনীয় এবং বহুল ব্যবহৃত অর্ধশতাধিক ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তালিকাভুক্ত এসব ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কোনো কোনো ওষুধের দাম ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের কারণে এমনিতেই সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। এই সময়ে অতি প্রয়োজনীয় ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণে কষ্ট বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
জানা গেছে, দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে। ওষুধের এই মূল্যবৃদ্ধির আগে অন্তত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে জানানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধু কোম্পানিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে এবার ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।
অনেক রোগী এবং তাদের স্বজনরা অভিযোগ করছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যখন তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা- এমন পরিস্থিতিতে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের। তবে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু এটি প্রচারের দায়িত্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।
জানা যায়, গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। প্রায় সাত বছর পর আবারও বাড়ানো হয়েছে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০ টাকা, ২৪ টাকার ইনজেকশন ৫৫ টাকা। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগে যে দামে ওষুধ কেনা যেত, এখন তার চেয়ে দ্বিগুণ কিংবা আড়াই গুণ টাকা গুনতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। ভোক্তারা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এমন দেশগুলোতে নাগরিকরা অসুস্থ হলে রাষ্ট্র তার যাবতীয় খরচ বহন করে। বাংলাদেশে কেউ অসুস্থ হলে তার ওষুধ ও চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার নিজেকেই বহন করতে হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবাও খুবই অপ্রতুল। এর মধ্যে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। সরকার ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে কিংবা নানাভাবে সহায়তা করে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি এড়িয়ে যেতে পারত। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ম মেনেই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। একটি টেকনিক্যাল কমিটি ওষুধ উৎপাদনকারীদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এরপর ওষুধের মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করে সেগুলোর নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। হঠাৎ বাড়ানো হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। তিনি বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে বাজারে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো কিছু ওষুধ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছে না। সবকিছু পর্যালোচনা করে ঔষধ প্রশাসনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির পরামর্শক্রমে সরকার ওষুধগুলোর দাম আপডেট করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের হাতে। এক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন ছিল। কিছু কিছু ওষুধের দাম যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত দামের চেয়েও মূল্য অনেকটা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি চাপে সাধারণ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ওষুধের ক্ষেত্রে তাদের ব্যয় আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। নতুন মূল্য অনুযায়ী, ৭০ পয়সার প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেট এখন ১ টাকা ২০ পয়সা। একই দামের প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেটের (র্যাপিড) দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ টাকা ৩০ পয়সা। প্যারাসিটামল ৬৫০ এমজি ট্যাবলেটের (এক্সআর) দাম ১ টাকা ৩০ পয়সা থেকে করা হয়েছে ২ টাকা। ১০০০ এমজি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম ১ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২৫ পয়সা করা হয়েছে। প্যারাসিটামল ৮০ এমজি ড্রপস ১৫ এমএল বোতলের দাম করা হয়েছে ২০ টাকা, আগের দাম ১২ টাকা ৮৮ পয়সা। জাইলোমেট্রোজালিন এইচসিআই ০.১% ন্যাজাল ড্রপ ১৫ এমএলের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। প্রোকলেপেরাজিন ৫ এমজি ট্যাবলেট, আগের দাম ৪০ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ৬৫ পয়সা। প্রোকলেপেরাজিন ১২.৫ এমজি ইনজেকশন, আগের দাম ৪ টাকা ৩৬ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা। ডায়াজেপাম ১০ এমজি/২ এমএল ইনজেকশন আগে ছিল ৩ টাকা ২২ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ৭ টাকা। মিথাইলডোপা ২৫০ এমজি ট্যাবলেটের আগের দাম ১ টাকা ৫০ পয়সা, এটি ১৩২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ টাকা ৪৮ পয়সা। এভাবে ৫৩টি ওষুধের অধিকাংশের দাম বেড়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত করা হয়েছে।