টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এতে দলীয় এমপিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে গা-ছাড়া ভাব। সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলেও তারা এলাকায় যান না, খোঁজখবর নেন না নির্বাচনি এলাকার জনগণের। খোঁজখবর নেন না স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও। তারা বেশিরভাগ সময় কাটান রাজধানী ঢাকায়। আবার কেউ বছরের বেশিরভাগ সময় থাকেন বিদেশে। অথবা থাকেন নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ দেখা বা শোনার সময় নেই তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই দুই ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে অথবা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে এলাকায় যান। তবে কেউ কেউ সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে চা চক্র, উঠান বৈঠকসহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নেন। এর বাইরে বেশিরভাগ এমপিই নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভালের জন্য ঢাকায় থাকেন। আর সংসদ অধিবেশন না থাকলে থাকেন বিদেশে। আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা মনে করেন, একজন এমপি জনপ্রতিনিধি। তিনি যদি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকেন, তাহলে তার কপাল তিনি নিজেই পোড়াবেন। কারণ সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত তথ্য, সামাজিক অবস্থা, জনসম্পৃক্ততা আছে কি না সেটি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। আগামী নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন তারাই পাবেন যারা এলাকায় যান, সরকারের উন্নয়ন মানুষের কাছে তুলে ধরেন।
একাধিক সূত্র জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যেসব এমপি স্থানীয় নেতাকর্মী বা সাধারণ মানুষের খোঁজখবর কম নেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রমেশ চন্দ্র সেন (ঠাকুরগাঁও-১), দবিরুল ইসলাম (ঠাকুরগাঁও-২), মনোরঞ্জন শীল গোপাল (দিনাজপুর-১), আবুল হাসান মাহমুদ আলী (দিনাজপুর-৪), মোতাহার হোসেন (লালমনিরহাট-১), এইচএন আশিকুর রহমান (রংপুর-৫), উম্মে কুলসুম স্মৃতি (গাইবান্ধা-৩), হাবিবর রহমান (বগুড়া-৫), সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১), ছলিম উদ্দীন তরফদার (নওগাঁ-৩), আয়েন উদ্দিন (রাজশাহী-২), আব্দুল কুদ্দুস (নাটোর-৪), তানভীর শাকিল জয় (সিরাজগঞ্জ-১), আবদুল মমিন মণ্ডল (সিরাজগঞ্জ-৫), আহমেদ ফিরোজ কবীর (পাবনা-২), সাহিদুজ্জামান খোকন (মেহেরপুর-২), সেলিম আলতাফ জর্জ (কুষ্টিয়া-৪), সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (চুয়াডাঙ্গা-১), আনোয়ারুল আজীম (ঝিনাইদহ-৪), নাসির উদ্দিন (যশোর-২), কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩), রণজিত কুমার রায় (যশোর-৪), কবিরুল হক (নড়াইল-১), হাবিবুন নাহার (বাগেরহাট-৩), পঞ্চানন বিশ্বাস (খুলনা-১), বেগম মন্নুজান সুফিয়ান (খুলনা-৩), আব্দুস সালাম মুর্শেদী (খুলনা-৪), মীর মোস্তাক আহমেদ রবি (সাতক্ষীরা-২), আফম রুহুল হক (সাতক্ষীরা-৩), ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু (বরগুনা-১), শাহজাহান মিয়া (পটুয়াখালী-১), মহিববুর রহমান (পটুয়াখালী-৪), নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন (ভোলা-৩), আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব (ভোলা-৪), পংকজ নাথ (বরিশাল-৪), বজলুল হক হারুন (ঝালকাঠি-১), তানভীর হাসান ছোট মনির (টাঙ্গাইল-২), আতোয়ার রহমান খান (টাঙ্গাইল-৩), ছানোয়ার হোসেন (টাঙ্গাইল-৫), আবুল কালাম আজাদ (জামালপুর-১), আতিউর রহমান আতিক (শেরপুর-১), এ কে এম ফজলুল হক (শেরপুর-৩), শরীফ আহমেদ (ময়মনসিংহ-২), কেএম খালিদ বাবু (ময়মনসিংহ-৫), ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল (ময়মনসিংহ-১০), মানু মজুমদার (নেত্রকোনা-১), আশরাফ আলী খান খসরু (নেত্রকোনা-২), অসীম কুমার উকিল (নেত্রকোনা-৩), ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (নেত্রকোনা-৫), নূর মোহাম্মদ (কিশোরগঞ্জ-২), রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক (কিশোরগঞ্জ-৪), আফজাল হোসেন (কিশোরগঞ্জ-৫), নাজমুল হাসান পাপন (কিশোরগঞ্জ-৬), নাইমুর রহমান দুর্জয় (মানিকগঞ্জ-১), আনোয়ারুল আশরাফ খান (নরসিংদী-২), রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু (নরসিংদী-৫), কাজী কেরামত আলী (রাজবাড়ী-১), মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (সুনামগঞ্জ-১), মুহিবুর রহমান মানিক (সুনামগঞ্জ-৫), মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী (সিলেট-৩), হাফিজ আহমেদ মজুমদার (সিলেট-৫), নুরুল ইসলাম নাহিদ (সিলেট-৬), নেছার আহমদ (মৌলভীবাজার-৩), গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ (হবিগঞ্জ-১), আব্দুল মজিদ খান (হবিগঞ্জ-২), বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১), উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩), এবাদুল করিম বুলবুল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫), এ. বি. তাজুল ইসলাম (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), সেলিমা আহমাদ (কুমিল্লা-২), ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (কুমিল্লা-৩), আ ক ম বাহাউদ্দিন (কুমিল্লা-৬), আ হ ম মোস্তফা কামাল (কুমিল্লা-১০), মহিউদ্দীন খান আলমগীর (চাঁদপুর-১), নূরুল আমিন রুহুল (চাঁদপুর-২), মোরশেদ আলম (নোয়াখালী-২), বেগম আয়েশা ফেরদাউস (নোয়াখালী-৬), আনোয়ার হোসেন খান (লক্ষ্মীপুর-১), মাহফুজুর রহমান (চট্টগ্রাম-৩), সামশুল হক চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১২), আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী (চট্টগ্রাম-১৫), আশেক উল্লাহ রফিক (কক্সবাজার-২), সাইমুম সরওয়ার কমল (কক্সবাজার-৩)সহ আরও অনেক এমপি রয়েছেন যারা এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ কম রাখেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ইসলাম বলেন, আমার মিটিং ছিল বলেই ঢাকা আসছি। এছাড়া শরীরও ভালো নেই। কিন্তু আমি বেশিরভাগ সময় এলাকাই থাকি।
রংপুর-৫ আসনের এমপিএইচএন আশিকুর রহমান বলেন, আমি এখন ঢাকায় আছি। এলাকায় তো যাই। তবে কেউ যদি বলে থাকে আমি এলাকায় যাই না, তারা বলতে পারেন। সেখানে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু ঢাকায় তো বিভিন্ন কাজে থাকতেই হয়। যখন প্রয়োজন হয়, তখন এলাকায় যাই। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলি।
গাইবান্ধা-৩ আসনের এমপি উম্মে কুলসুম স্মৃতি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি প্রতি মাসে একবার যাওয়ার চেষ্টা করি এলাকায়। কারা কী বলল তা জানি না। আপনি আরও ভালো করে এলাকায় খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, আমিও একজন এমপি। আমি এলাকায় থাকি। আমারটা আমি বলতে পারি। তবে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই সবার বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন। খোঁজখবর নিয়েই তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। ওই সংস্থার কাজ থেকে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপিদের আমলনামা নিচ্ছেন। কে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বেশি রাখেন তার আমলনামায় চলে আসবে। সেই অনুযায়ী কার কী গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা রয়েছে সেটি উঠে আসবে। এ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেবেন দলের সভাপতি।
আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, একজন এমপি জনপ্রতিনিধি। তিনি যদি জনগণের কাছে না যান, তার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। আগামীতে নির্বাচন। এ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে দলীয় মনোনয়ন পেতে হবে। কিন্তু এমপিরা যদি এলাকায় না যান, সরকারের উন্নয়ন যদি জনগণের কাছে তুলে না ধরেন, তাহলে সেখানে দলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে গেলে, দল, দেশ ও নিজেরই উপকার হবে। কারণ দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার আগে প্রত্যেকের কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তাই যেমন কর্ম তেমন ফলই হবে।