রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীন রিকশা। মানছে না সড়ক পরিবহন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নগরের অলিগলিতে দিন-রাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ বাহন। আর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখনো কখনো চলে যায় প্রধান সড়কে।
রাত ৯টার পর ও সকাল ৭টার আগে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে প্রায়ই চলে এ রিকশা। প্যাডেলে চালিত রিকশার চেয়ে নিয়ন্ত্রণহীন এসব রিকশার গতি বেশি হওয়ায় ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। ফলে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা, পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট।
এদিকে সারা দেশে দেয়া হয়েছে লোডশেডিংয়ের শিডিউল। অন্যদিকে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে দেয়া হচ্ছে এ অটোরিকশার ব্যাটারির চার্জ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যানেজ করে ঢাকা শহরে রিকশাগুলো চলছে। ম্যানেজ করার সংস্কৃতি থেকে যতদিন বের না হওয়া যাবে ততদিন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। তাই কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ঢাকা শহর থেকে রিকশা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি চালকদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও করতে হবে।
জানা যায়, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে দুই দফায় হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান প্রধান সড়কে এ ধরনের রিকশা চলাচল বন্ধ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ২০২১ সালের ২০ জুন সচিবালয়ে রিকশা-ভ্যান বন্ধের নির্দেশ দেন। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের বাহন বন্ধে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন অভিযান পরিচালনাও করে। পাশাপাশি রিকশা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। সব নির্দেশনা উপেক্ষা করে দুইসিটিতে দেদার চলছে রিকশা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভাটারা থানার নতুন বাজার ১০০ ফিট, সোলমাইদ, জগন্নাথপুর, এ্যাপোলো সড়ক, উত্তর বাড্ডা ও মধ্য বাড্ডা, লালমাটিয়া, তেঁজগাও, সাতরাস্তা, পুরান ঢাকার সদরঘাট ও শ্যামবাজার। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, দনিয়া, কাজলা, রায়েরবাগ, কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, মান্ডা, খিলগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুরের ১০, ১১, ১২ ও ১৩, পল্লবী, শাহআলী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, মানিকদী, মোহাম্মদপুর, বছিলা, মুগদা, বাসাবো, হাজারীবাগ, জিগাতলা, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দেদার চলছে রিকশা। অলিগলির ভেতরে এসব রিকশা চললেও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুযোগ বুঝেই গলি থেকে বের হয়ে মহাসড়কেও উঠে যাচ্ছে।
এছাড়াও এসব রিকশা সারাদিন চালানোর পর রাতভরে ব্যাটারিগুলো চার্জ দেয়া হচ্ছে। অনেকে আবার অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে ব্যাটারিগুলো চার্জ দিচ্ছেন। এতে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। গত ১ আগস্ট সোমবার তেঁজগাও এলাকায় এ ঘটনার প্রমাণ মেলে।
স্থানীয়রা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এখানে অবৈধভাবে ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া হচ্ছে। ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য মালিককে প্রতিমাসে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। পাশাপাশি মালিককে প্রতিদিন ভাড়াবাবদ এলাকাভেদে দিতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়াও এসব রিকশা বন্ধে বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশনও অভিযান পরিচালনা করে। আবার বিভিন্ন সময় পুলিশ এসব অটোরিকশা ধরে জরিমানাও করছে। তাতেও কোনো কাজে আসছে না বলে জানায় কয়েকজন ট্রাফিক সদস্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে রিকশা বেশি দ্রুতগতির হওয়ায় চালকরা এ বাহন চালাতে বেশি আগ্রহী। ফলে দ্রুতগতির হওয়ায় দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। নিয়ন্ত্রণহীন এসব বাহনের ফলে অলিগলিতে সবসময় যানজট লেগেই থাকছে। কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকায় এ বাহনগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ম্যানেজ করে ঢাকা শহরে এ রিকশাগুলো চলছে। ম্যানেজ করার সংস্কৃতি থেকে যতদিন বের না হওয়া যাবে ততদিন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। তাই কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ঢাকা শহর থেকে রিকশা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি এসব চালকদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার কয়েকজন রিকশা মালিক ও চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ এলাকায় রিকশার পরিমাণ প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। আর উত্তরেও লক্ষাধিক বলে চালক ও মালিকরা জানায়। তবে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে এর সঠিক হিসাব নেই।
এছাড়া প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতারা এসব বাহনের মালিক। পাশাপাশি তাদের ছত্রছায়ায় আবার অনেকে রিকশার মালিক। ফলে অভিযান ও নির্দেশনা উপক্ষো করেই ঢাকা সিটিতে এসব বাহন হরহামেশাই চলছে। নতুন বাজার ১০০ ফিট এলাকায় রিকশা চালান ফজলুল করিম।
তিনি বলেন, তার এই রিকশার মালিক স্থানীয় এক নেতা। তিনি ৪০০ টাকা দৈনিক ভাড়া দিয়ে রিকশাটি চালান। আর চার্জ বাবদ প্রত্যেক মাসে ১৫শ টাকা দিতে হয়। মাঝে মাঝে পুলিশ ধরলে ৫০০ টাকায় ছাড়িয়ে নিতে হয়। আর ডাম্পিংয়ে দিলে ১১শ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে হয়। আবার কোনো কোনো সময় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকাও লাগে।
পুরান ঢাকার রিকশাচালক শরিফুল বলেন, এ এলাকায় হাজার হাজার রিকশা চলে। অলিগলিতে এ রিকশা চালাতে তেমন কোনো সমস্যা নাই। তবে পুলিশ না থাকলে মাঝে মাঝে প্রধান সড়কে যায়।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সিটি কর্পোরেশনগুলোর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, ঢাকা শহরে কোনো রিকশা চলতে পারবে না।
একদিকে এ ধরনের বাহনের অনুমতি নেই, অন্যদিকে কয়েক লাখ রিকশা শহরে চলছে। ফলে সড়কে চাপ ফেলছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটছে। নগরে যখন আইনের শাসন না থাকে, তখন এ রিকশার মালিকরা কোনো না কোনোভাবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের ম্যানেজ করে অটোরিকশা চালাচ্ছে।
এ ম্যানেজ করার সংস্কৃতি যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত নগরের সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না। শুধু অভিযান পরিচালনা করে এ বাহন বন্ধ করা যাবে না। কারা এ বাহনগুলো সড়কে চলতে সহায়তা করে, এককথায় যারা এর সাথে জড়িত তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই রিকশা বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও রিকশা উচ্ছেদের পাশাপাশি এসব চালকদের জন্য বিকল্প চিন্তাও সরকারকে করতে হবে।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন দৈনিক বলেন, ঢাকা শহরে যখন ২০০ অটোরিকশা ছিল তখনো এগুলো বন্ধ করতে বলেছি।
আর এখন তো ঢাকা ও তার আশপাশে প্রায় চার লাখ অটোরিকশা রয়েছে, এখনো বন্ধ করতে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ লিপি দিচ্ছি। আমি চাই ঢাকা শহরের সব অটোরিকশা বন্ধ করে দেয়া হোক। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেরগুলোও বন্ধ করে দেয়া হোক। এ ধরনের রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে বহু বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব এগুলো বন্ধ করে দেয়া। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমানকে কয়েকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) সেলিম রেজা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদকে কয়েকবার কল দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক বাজেট অনুষ্ঠানে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক এলাকায় অটোরিকশায় সয়লাব। প্রতিটি অটোরিকশায় চারটি করে ব্যাটারি থাকে।
এসব বাহন সারাদিন চালানোর পর ব্যাটারিগুলো সারারাত চার্জে দেয়া হয়। ফলে রিকশা বিদ্যুৎধ্বংসী। পাশাপাশি এসব রিকশায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। নগরীতে আগে অনেক প্যাডেলচালিত রিকশা চলত, এখনো চলে। পায়েচালিত রিকশা তো আমরা বন্ধ করে দেইনি। তাই যারা অটোরিকশা বা রিকশা চালান তারা পায়েচালিত রিকশা চালাবেন।